‘ফিলিস্তিন সংহতি দিবস’ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

বিশেষ প্রতিবেদক, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪
আজ ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত ফিলিস্তিন সংহতি দিবস। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২৯ নভেম্বরকে ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রদর্শনস্বরূপ “আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস” হিসেবে গ্রহণ করে। এর দশ বছর পরে ১৯৮৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ‘ইউনাইটেড নেশনস পার্টিশন প্ল্যান ফর প্যালেস্টাইন’ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরপর থেকে এ দিনটি “আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস” হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
‘ফিলিস্তিন’ (যা প্যালেস্টাইন নামেও পরিচিত) ভূখণ্ডটি আগে ছিল একটি রাষ্ট্র। সে সময় এর লোক সংখ্যা ছিল ১০ লাখের মত, যার অধিকাংশই ছিল আরব জাতিভুক্ত। মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের দু’ভাগ ছিল আরব জাতি গোষ্ঠীর, একভাগ ছিল ইহুদি। তখনকার লীগ অব নেশন্স-এর (জাতিসংঘের পূর্বের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘জাতিপুঞ্জ’) ম্যান্ডেট অনুসারে ব্রিটিশরা এ ভূখণ্ডটি শাসন করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশরা ইহুদিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের গোপন অঙ্গীকারে আবদ্ধ ছিল। বিশ্ব যুদ্ধের পরে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে জেরুজালেম শহরকে আন্তর্জাতিক শহরের মর্যাদা দিয়ে ‘ফিলিস্তিন’ ভূখণ্ডকে আরব ও ইহুদি অধ্যুষিত দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ব্রিটিশ ও মার্কিন সমর্থনের কারণে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য “ইসরায়েল” রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের নানা প্রান্তের ইহুদিরা নতুন রাষ্ট্রে আবাসন গড়ে তোলে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন তো দূরের কথা, তারা নিজ আদি নিবাস থেকে বিতাড়িত হতে থাকে। তখন থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আরব ইহুদি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, বর্তমানে তা গুরুতর বিশ্ব সংকটের রূপ নিয়েছে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন-আলাদা দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও পাশ্চাত্য শক্তির ষড়যন্ত্র আর নিজেদের মধ্যকার বিভক্তি ও দুর্বলতার কারণে এতদিন ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হতে পারেনি। সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের পক্ষে প্রস্তাব পাস হবার সময় ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশ বিরোধিতা করেছিল। আরও ৪৫টি দেশ ইস্রায়েলের অনুকূলে প্রস্তাব পাসের সময় অনুপস্থিত ছিল। এত বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন।
২০১২ সালে প্রথম বারের মত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশে ফিলিস্তিন পতাকাও স্থান পায়। সাধারণত জাতিসংঘ দপ্তরে পূর্ণ সদস্য অর্থাৎ স্বাধীন রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলনেরই রেওয়াজ রয়েছে। সেদিক থেকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এটি একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়।
১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় হোয়াইট হাউসে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) ও ইসরায়েলের মধ্যে ‘অসলো চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার প্রধান প্রধান শহর ও শহরতলীর নিয়ন্ত্রণ একই চুক্তির বলে গঠিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (Palestinian Authority or PA) কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু এই চুক্তি ইসরায়েলের দখলদারিত্ব অবসান ঘটাতে পারেনি। উপরন্তু ইসরায়েল এই চুক্তিকে ব্যবহার করে ১৯৬৭ সালে দখলকৃত জমিতে তার বেআইনী বসতিস্থাপন কার্যক্রমের বিস্তার ঘটায়। বর্তমান এই চুক্তির কার্যকারিতা নেই বললেই চলে।
ফিলিস্তিনীদের জীবন এখন ইসরায়েলী সামরিক দখলের অধীনে জর্জরিত। প্যালেস্টাইনের ডি ফেক্টো রাজধানী রামাল্লা থেকে তারা যেদিকেই বের হয়ে যান না কেন, তাদেরকে সব সময় ইসরায়েলি চেকপোস্ট, সৈন্য ও বসতির মুখোমুখি হতে হয়। অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেটেলারদের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ১০ হাজার। এখন তাদের সংখ্যা সাত লক্ষেরও বেশি। অর্থাৎ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতিস্থাপন ৩ গুণ বেড়েছে। অধিকন্তু ইসরায়েল এখনও ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ডে বেআইনী বসতিস্থাপন অব্যাহত রেখেছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, নিরীহ শিশু কিশোরসহ আন্দোলনকারীদের হত্যা করছে এবং ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। স্থল, সমুদ্র ও আকাশ পথে গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
গত বছর ৭ অক্টোবর গাজা নিয়ন্ত্রণকারী হামাস ইসরায়েলের অভ্যন্তরে পরিকল্পিত এক হামলা চালানোর পর থেকে ইসরায়েল প্রতিশোধমূলকভাবে গাজায় আকাশ থেকে বোমা বর্ষণ ও স্থল হামলা শুরু করে। হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে শুরু করে কোন কিছুই হামলা থেকে বাদ যায়নি। এ হামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় নারী-শিশুসহ নিহতের সংখ্যা ৪৪ হাজার ২৮২ জনে পৌঁছেছে এবং অন্তত এক লাখ ৪ হাজার ৮৮০জন ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন আরো হাজার হাজার মানুষ। প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ইসরায়েলের হামলার ফলে গাজা এখন এক বিধ্বস্ত ও মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যুদ্ধ বা হামলা বন্ধের জন্য ইসরায়েলের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখলেও হামলা এখনো চলমান রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের এক দশমাংশ জায়গা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এক সময় এই অঞ্চলটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও কালক্রেমে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বর্তমানে বাংলাদেশের করতলগত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুখণ্ডটি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পরই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার মাধ্যমে সামরিকায়ন ঘটে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে সেখানে বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনী মোতায়েন রেখে সামরিক শাসন জারি রাখার মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের ওপর দমন-পীড়ন চলছে। বিভিন্ন সময়ে চালানো হয়েছে ডজনের অধিক গণহত্যা ও বিশটির অধিক বড় আকারের সাম্প্রদায়িক হামলা। এছাড়া অন্যায় দমন-পীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতন, বিচার বহির্ভুত হত্যা, ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতন, খুন, গুম ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাতো প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে।
বলা চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন আরো এক ফিলিস্তিন। ইসরায়েল যেভাবে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল ও ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর অবিরাম দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, একইভাবে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠিও পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যায় দমন-পীড়ন জারি রেখেছে। সেনাশাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’ ও দমনমূলক ’১১ নির্দেশনা’ জারির মাধ্যমে এ অঞ্চলে চালানো হচ্ছে অবর্ণনীয় নিপীড়ন। জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সশস্ত্র ঠ্যাঙারে বাহিনী। যারা সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় ও মদদে খুন-গুম, অপহরণ, নারী ধর্ষণের মতো ঘটনা সংঘটিত করে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি সংহতি দিবস পালনে বাধা-হামলা : নির্যাতিত লাঞ্ছিত জনগোষ্ঠী হিসেবে ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে বিশ্বের অপরাপর নিপীড়িত জনগণ যেমন সব সময়ই সংহতি জানিয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারহারা, নিপীড়িত পাহাড়ি জনগণও ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে একাত্মতাবোধ করে এবং ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী ধ্বংসযজ্ঞের নিন্দা জানায়।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ঘোষিত ফিলিস্তিন সংহতি দিবস পালন করতে গিয়েও বাংলাদেশের সেনা-পুলিশের হামলার শিকার হতে হয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে বিগত ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিন সংহতি দিবস উপলক্ষে ’৭১-এর গণহত্যার দায়ে পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সকল গণহত্যা ও যুদ্ধপরাধের বিচার কর শ্লোগানে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জনগণের পক্ষে অধিকারকামী ৮ গণসংগঠন (গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ, সাজেক নারী সমাজ, সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটি, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি ও প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড)-এর কনভেনিং কমিটি খাগড়াছড়ি সদরে ছাত্র-যুব-নারী সংহতি সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করলে তাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাধা দেয় ও হামলা চালিয়ে সমাবেশ ভণ্ডুল করে দেয়। এ সময় পুলিশ হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি নিরূপা চাকমা ও সদস্য দ্বিতীয়া চাকমাসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে। পরে ২ ছাত্রকে ছেড়ে দিলেও নিরূপা ও দ্বিতীয়া চাকমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। উক্ত হামলায় নারীসহ অন্তত ১৪ জন আহত হয়। সে সময় প্রথম আলো, সমকাল সহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় এবং টেলিভিশনে এ ঘটনা নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়।

২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর ‘ফিলিস্তিন সংহতি দিবস’ উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৮ গণসংগঠনের কনভেনিং কমিটির আয়োজিত ছাত্র-যুব-নারী সংহতি সমাবেশের মিছিলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ হামলা চালায়। এতে অন্তত ১৪ জন আহত হয়। #ফাইল ছবি
বলা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে শাসকগোষ্ঠির দ্বি-চারিতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এদেশের সরকার তথা শাসকগোষ্ঠি লোকদেখানোর জন্য ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিলেও চরিত্রগতভাবে তার বিপরীতে তাদের অবস্থান। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় তারা ইসরায়েলের ভূমিকা পালন করে থাকে। অধিকারকামী পাহাড়ি জনগণকে দমিয়ে রাখতে নিপীড়ন-নির্যাতনের পন্থা বেছে নেয়। যার কারণে ফিলিস্তিনি সংহতি দিবস পালন করতে গেলেও হামলার শিকার হতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরে এ অবস্থা চলমান রয়েছে।
মোট কথা, ফিলিস্তিনি জনগণকে যেভাবে নিজেদের ভুখণ্ড রক্ষার্থে লড়াই সংগ্রাম জারি রাখতে হচ্ছে, একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত-নির্যাতিত পাহাড়ি জনগণকেও নিজেদের অস্তিত্ব তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষার্থে লড়াই সংগ্রামে নিয়োজিত হতে হবে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।