অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাসে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর হাতে হত্যার শিকার ৭ জন

0

বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গত বছর জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর নোবেলজয়ী ড. ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের ৬ মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর হাতে অন্তত ৭ জন বিচার বহির্ভুত হত্যার শিকার হয়েছেন।

এর মধ্যে দীঘিনালায় ১ জন, খাগড়াছড়ি সদরে ২ জন, বান্দরবানে ৩ জন ও রাঙামাটির লংগদুতে ১ জন রয়েছেন।

বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতার ওপর নৃশংসভাবে ব্রাশ ফায়ার, শারিরীক নির্যাতন ও কথিত ‘গোলাগুলির’ নাটক সাজিয়ে এসব হত্যার ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে।

কিন্তু এসব ঘটনার বিচার তো দূরের কথা ঘটনায় জড়িত সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যরা এখনো বহাল তবিয়তে থেকে নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঘটনাগুলো সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো:

দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি) : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বিকালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সেটলার বাঙালিরা যখন পাহাড়িদের ওপর হামলা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছিল তখন তা প্রতিরোধ করতে এলাকার লোকজনের সাথে রাস্তায় নেমে আসেন ৬৭ বছর বয়সী ধন রঞ্জন চাকমা। তারা মাইনি ব্রিজ এলাকায় প্রতিরোধমূলক অবস্থান নিলে সেনাবাহিনীর একটি দল সেখানে গিয়ে ফাঁকা গুলিবর্ষন ও লাঠিচার্জ করে লোকজনকে ছত্রভঙ্গ দেয়। এতে পালাতে না পেরে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন ধন রঞ্জন চাকমা। 

দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর হামলা-নির্যাতনে নিহত ধন রঞ্জন চাকমা, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪। ফাইল ছবি


এরপর সেনারা ধন রঞ্জন চাকমার ওপর অমানুষিক শারিরীক নির্যাতন চালায় ও বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে ঠোটে, হাতে-পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে পড়লে পরে সেনারা মুমুর্ষু অবস্থায় তাকে একটি স্থানে ফেলে রেখে যায়। এরপর স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। রাতে সেখানে তার মৃত্যু হয়। হাসপাতালে নেয়ার পথেও সেনারা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ঘটনার পরবর্তী অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দীঘিনালায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিচারের আশ্বাস দিয়ে আসলেও এখনে এর কোন বিচার কিংবা দোষীদের আইনের আওতায় আনা হয়নি।

খাগড়াছড়ি সদর: দীঘিনালায় সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে এবং খাগড়াছড়ি সদর এলাকায় যাতে দীঘিনালার মতো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা সংঘটিত হতে না পারে সেজন্য ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাতে এলাকার ছাত্র-জনতা খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর, নারাঙহিয়া, উপালিপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভে নেমে পড়েন। তারা খাগড়াছড়ি সদর – পানছড়ি সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলেন।

সেদিন রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টা হতে ১২টার মধ্যে সেনাবাহিনীর একদল সদস্য নারাঙহিয়া ও স্বনির্ভরের জেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার ওপর উপর্যুপুরি ব্রাশফায়ার করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে কলেজ ছাত্র জুনান চাকমা ও রাজমিস্ত্রী রুবেল ত্রিপুরা মারা যান। এতে আরো অন্তত ২১ জন গুরুতর আহত হন, যাদের মধ্যে অনেকে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি।

?????, ????? – 1

খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত জুনান চাকমা (বামে) ও রুবেল ত্রিপুরা (ডানে), ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪। ফাইল ছবি


এ ঘটনায় ব্যাপক বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। নিহতদের পরিবারের লোকজন ঢাকায় গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের কাছে এ ঘটনার বিচার চান। কিন্তু ঘটনার আজও কোন সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি।

এ ঘটনায় খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসান ও খাগড়াছড়ি সদর জোন কমাণ্ডার আবুল হাসনাত জুয়েল জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু এ ঘটনা নয়, তারা খাগড়াছড়িতে আরো বহু হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। মূলত তারা হলেন হাসিনা সরকারের আমলেই নিয়োজিত সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু হাসিনা সরকারের পতনের পরও তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা তো নেয়াই হয়নি, বরং তাদেরকে এখনো বহাল তবিয়তে রেখে পাহাড়িদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে।

রুমা (বান্দরবান): গত ২৪ নভেম্বর ২০২৪ সকালে বান্দরবানে রুমায় সেনাবাহিনীর অভিযানকালে ‌’কেএনএফের সাথে কথিত ‌গোলাগুলির’ নাটক সাজিয়ে এক নারীসহ ৩জনকে বিচার বহির্ভুতভাবে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী দুজন ও আরেকজন সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ রয়েছেন।

নিহতরা হলেন- ১. এল্ডার পেনখুপ (৭২), গ্রাম- সারন পাড়া, ২. মেসি ভাললাললিয়ান (১৯), গ্রাম- হেপি হিল ও ৩. এলি ভানজিরপার (১৮); স্বামী- মেসি ভানলাললিয়ান। এর মধ্যে এলি ভানজিরপার গর্ভবতী ছিলেন বলে জানা গেছে।

বান্দরবানে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত বম জাতিসত্তার তিনজন। সংগৃহিত ছবি

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। উপরন্তু সেনাবাহিনী নিহতদের ‘‌কেএনএফ সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করে ঘটনা আড়াল করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। উল্লেখ্য, এ ঘটনার আগে গত বছর এপ্রিল থেকে বান্দরবানে একই কায়দায় আরো বহু বিচার বহির্ভুত হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যার কোন তদন্ত ও বিচার হয়নি।

লংগদু (রাঙামাটি): গত ২ জানুয়ারি ২০২৫ রাঙাামটির লংগদু উপজেলায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা এক যুবককে গুলি করে বিচার বহির্ভুতভাবে হত্যা করে।

স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা যায়, ঐদিন লংগদু সেনা জোনের একদল সেনা সদস্য কিজিংছড়া গ্রামে অপারেশনে যায়। এ সময় সেনারা ব্রাশফায়ার করে এলাকায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এতে ভয়ে পালানোর সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা কিজিংছড়া গ্রামের রাস্তা থেকে এক যুবককে ধরে মারপিট করতে করতে নিয়ে যায় এবং ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। পরে তাকে সেনাবাহিনীর পোশাকের আদলের পোশাক পরিয়ে দিয়ে আইএসপিআর থেকে প্রচার করা হয় যে “সেনাদের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ‘ইউপিডিএফ’ সদস্য নিহত হয়েছে”। কিন্তু স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, সেনারা তাকে ধরে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে।

নিহত ওই যুবকের নাম চাইংপা মার্মা (৩৯) ও তার বাড়ি খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলায় বলে জানা গেছে। তিনি তার এক বন্ধুর সাথে সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

উক্ত ঘটনাবলী প্রমাণ করে দেশে শিক্ষার্থী জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠির নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। পূর্বেকার ফ্যাসিবাদী সরকারের নীতি বহাল রেখে একই কায়দায় পাহাড়ে সেনাবাহিনীকে দিয়ে অবর্ণনীয় নিপীড়ন-নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে।

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের আমলে অসংখ্য বিচার বহির্ভুত হত্যার ঘটনা ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। এর মধ্যে উদাহরণ হিসেবে ২০১৪ সালে জেএসএস(এমএন লারমা) সংগঠক তিমির বরণ চাকমা, ২০১৭ সালে ছাত্রনেতা রমেল চাকমা ও ২০২২ সালে ইউপিডিএফ নবায়ন চাকমা মিলনকে সেনারা ধরে নিয়ে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল। আর অনেককে ধরে নিয়ে কথিত গোলাগুলির নাটক সাজিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছিল, যার তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু এসব ঘটনার কোন বিচার হয়নি। উল্টো ঘটনায় জড়িত সেনা কর্মকর্তারা প্রমোশন পেয়েছিলেন।

ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পথে হাঁটছে কিনা জনমনে এখন সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 

সম্প্রতি রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে সেনা অপারেশনের নামে এলাকার জনগণকে হয়রানি, অন্যায়ভাবে আটক, ধর্মীয় পরিহানিসহ নানা দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সচেতন মহল বলছেন, বাংলাদেশকে সত্যিকার একটি নিপীড়নমুক্ত ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহারপূর্বক সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। অন্যথায় গোটা দেশে এ সেনা শাসনের কালো থাবা বিস্তার করতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গত ৩০ জানুয়ারি রাতে কুমিল্লায় আটকের পর সেনাবাহিনীর নির্যাতনে একজনের মৃত্যুর ঘটনা তারই উদাহারণ হতে পারে বলে তারা মন্তব্য করেন।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More