পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জেনেভায় জুম্মদের প্রতিবাদ সমাবেশ

0

ডেস্ক রিপোর্ট, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ২ মার্চ ২০২৫

পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জুম্মদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডে বসবাসরত জুম্মদের উদ্যোগে জেনেভায় জাতিসংঘ অফিস সংলগ্ন Broken Chair এর পাদদেশে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, শুক্রবার ফ্রান্সভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন La Voix Des Jummas (LVJ)-এর মূল আয়োজনে অনুষ্ঠিত উক্ত প্রতিবাদ সমাবেশে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিল আন্তর্জাতিক পাঁচটি স্বনামধন্য মানবাধিকার সংস্থা France Libertés- Fondation Danielle Mitterrand; Survival; Icra International; Netherlands Centre for Indigenous Peoples (NCIV); International Work Group for Indigenous Affairs, Denmark.

এছাড়া জুম্ম ‘আদিবাসী’দের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম Global Association For Indigenous People of Chittagong Hill Tracts (GAIPCHT)সহ আরও কিছু সংগঠন সংহতি জানিয়ে সমাবেশে অংশগ্রহণ করে।

সমাবেশ আয়োজক সংগঠন La Voix Des Jummas (LVJ)-এর ব্যানারে লেখা ছিল “United Against Violence and Killing of Indigenous Jumma People in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh”.

সমাবেশে বিভিন্ন সংগঠন তাদের নিজ নিজ ব্যানার নিয়ে অংশ নেন। এতে GAIPCHT’র প্রদর্শিত ব্যানারে লেখা ছিল `Stop Ethnic Cleansing in Chittagong Hill Tracts, Bangladesh‘.

দক্ষিণ ফ্রান্সে বসবাসরত রোমান চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- Agnes Golfier, “co-directeur” of France Libertés- Fondation Danielle Mitterrand এবং প্রধান আলোচক ও প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন LVJ সংগঠনের সভাপতি প্রফেসর রেমি ফ্লেমিংগার চাকমা, বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন সমাজকর্মী সমাপ্তি চাকমা, জ্ঞানলোক চাকমা, মিস ত্বরা মৃ।

এতে আরো অংশ নেন, সমাজকর্মী ও ট্রান্সলেটর আয়ডিন, নৃত্যশিল্পী ও নাচের শিক্ষক সূচরিতা ত্রিপুরা, মানবাধিকার কর্মী স্মরণিকা চাকমা, বিটু চাকমা, স্মৃতিকা, টাটু, নিপুনিকা, চিসোনা, সঞ্চয় চাকমা প্রমুখ। 

ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন শহর থেকে আগত নানা স্তরের প্রায় ১০০ জনের মতো জুম্ম আদিবাসী এই সমাবেশে অংশগ্রহন করেন।

সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দেন এবং নানা দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন অংশগ্রহণকারীরা। তারা সম্প্রতি বান্দরবানের লামায় আটক ভূমি রক্ষা আন্দোলনের নেতা রিংরং ম্রো’র মুক্তির দাবি জানান।

জুম্মদের সংস্কৃতি তুলে ধরে সমাবেশে নাচ, গানও পরিবেশ করা হয়।

সমাবেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি হানাহানি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।

সমাবেশে প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন, তারা ৪০ বছর ধরে পাহাড়ের জুম্ম আদিবাসীদের জন্য কাজ করছেন। পাহাড়ের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে অবগত আছেন এবং তারা পাহাড়ে আদিবাসীদের জন্য শান্তি ও সকল প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান, ক্ষতিপূরণসহ পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন চান।

অন্যান্য বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান। আর বাংলাদেশ সরকারকে পাহাড়ের জুম্ম আদিবাসীদের সুযোগ-সুবিধায় পিছিয়ে না রেখে রাষ্ট্রের মূলধারায় সংযোগসহ আন্তরিক হয়ে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়। নতুবা পাহাড়ে যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে তার দায় সম্পূর্ণ সরকার ও রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে বলে মতামত ব্যক্ত করা হয়।

তাঁরা আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম আদিবাসীরা তাদের ভূমি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মৌলিক এবং রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।

প্রতিবাদ সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান এবং ন্যায়বিচারের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।

সমাবেশে প্রদর্শিত বিভিন্ন ব্যানার-প্ল্যাকার্ডে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন বন্ধ করা, সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার, জুম্মদের জাতিগত ও ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে নিরপেক্ষ তদন্ত চালানো, জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি তুলে ধরা হয়।

সমাবেশ শেষে তারা জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের রাষ্ট্রদূত তারেক মো. আরিফুল ইসলামের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের বরাবরে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।

স্মারকলিপিতে তারা গত বছর ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা, নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহত নিপীড়ন-নির্যাতন, ঢাকার মতিঝিলে এনসিটিবি ভবনের সামনে ‘আদিবাসী’ শিক্ষার্থীদের ওপর স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির হামলা এবং সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বান্দরবানের লামা উপজেলায় ভূমি রক্ষা আন্দোলনের নেতা রিংরং ম্রোকে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক আটকের ঘটনা উল্লেখ করেন।

স্মারকলিপিতে ৬ দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো-
১. ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান।
২. হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচারিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পার্বত্য এলাকায় চলমান বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করা।
৩. মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে নিরপেক্ষ তদন্ত চালানো এবং এসব ঘটনায় সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা মূল্যায়ন করা।
৪. ‘অপারেশন উত্তরণ’ বন্ধ করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সামরিক ক্যাম্প ছাড়া অন্যান্য অস্থায়ী সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহার করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া।
৫. জুম্ম জনগণের কাছ থেকে জোরপূর্বক দখল করা জমি ফেরত দেওয়া এবং পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ভূমি কমিশনের মাধ্যমে সকল জমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা।
৬. ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More