খাগড়াছড়ির পূর্ণচন্দ্র পাড়ায় সেনা হামলা: ঘরবাড়ি তল্লাশি-ভাঙচুর-লুটপাট ও গ্রামবাসীদের হেনস্তার অভিযোগ

0

 সেনাবাহিনী কর্তৃক বাড়ি ভাঙচুরের চিত্র।


খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ

সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোন ছড়া ইউনিয়নের পূর্ণ চন্দ্র কার্বারি পাড়ায় সেনাবাহিনী হামলা চালিয়ে ঘরবাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি-ভাঙচুর-লুটপাট ও নিরীহ গ্রামবাসীদের মারধর, হেনস্তার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আজ সোমবার (২১ এপ্রিল ২০২৫) ভোরে খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের সেনা সদস্যরা এ ঘটনা সংঘটিত করে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আজ ভোর সাড়ে ৫ টার সময় বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য ভাইবোন ছড়া ইউনিয়নের পূর্ণ চন্দ্র কার্বারী পাড়ায় হানা দেয়। তারা গ্রামটি ঘেরাও করে ঘরবাড়িতে তল্লাশি চালায়। এ সময় তারা তালাবদ্ধ একটি মাটির গুদাম ঘরে দরজা-জানালা ভেঙ্গে প্রবেশ করে ব্যাপক তল্লাশি তাণ্ডব চালায়। পরে সেখানে কিছু সাংবাদিকসহ হাজির হন ব্রিগেড কমাণ্ডার শরীফ মো. আমান হাসান। তিনি সাংবাদিকদের দিয়ে ওই বাড়িটাকে ‘ইউপিডিএফের গোপন আস্তানা, এই আস্তানা থেকে ইউপিডিএফ রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করে”… ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার করায়।’

সেনাবাহিনী কর্তৃক বাড়ি ভাঙচুরের চিত্র।

সেনাবাহিনী কর্তৃক বাড়ি ভাঙচুরের চিত্র।


এ সময় সেনারা গ্রামের অন্তত ৯ গ্রামাবসীকে সাময়িকভাবে আটক করে মারধর, হেনস্তা ও হয়রানি করে। পরে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে আগামীকাল (মঙ্গলবার) সকালে দেওয়ান পাড়া ক্যাম্পে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

যারা হেনস্তার শিকার হয়েছেন তারা হলেন- ১. খোকনাদ ত্রিপুরা (বৈষ্ণব), বয়স ৫৭ পিতা-মৃত. পূর্ণ মোহন বৈষ্ণব, ২.জগদীশ ত্রিপুরা (৬০), পিতা- মৃত ধনোই ত্রিপুরা, ৩. অর্জুন ত্রিপুরা (৩৬), পিতা- জগদীশ ত্রিপুরা, ৪. কতা ত্রিপুরা (৩০), পিতা- পজেন ত্রিপুরা,  ৫. বিতান ত্রিপুরা (৩০), পিতা-ধনক ত্রিপুরা, ৬.ভক্তি ত্রিপুরা (৩৮), পিতা- মিলন জ্যোতি ত্রিপুরা, ৭. উত্তম ত্রিপুরা (৩৮), পিতা- যশা ত্রিপুরা, ৮.চরণ ত্রিপুরা (৫৮), পিতা- মৃত জাপান ত্রিপুরা ও ৯. পথৈই ত্রিপুরা (৩২), পিতা- মৃত লতা ত্রিপুরা।

সেনারা খোকনাদ ত্রিপুরা কানে কম শোনার কারণে তাকে কান টেনে ধরে নির্যাতন করে। এছাড়া কয়েকজনকে চড়-থাপ্পড় দেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হেনস্তার শিকার হওয়া গ্রামবাসীরা।

এ সময় সেনারা বাড়ির মালিকের ২টি নারিকেল গাছ থেকে বিনামূল্যে ডাব ছিঁড়ে খেয়ে দেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

সেনারা বাড়িটি ভাঙচুর (বাড়ির দরজা-জানালার দেওয়ালও ভেঙে দেওয়া হয়) ও তল্লাশি চালিয়ে জিনিসপত্র তছনছ করে দেয়ার পর সেখানে পাওয়া ইউপিডিএফ’র প্রকাশিত বইসহ বিভিন্ন বইপত্র, পত্রিকা, পোস্টারসহ বিভিন্ন কাগজপত্র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরপর চলে যাবার সময় সেনারা বাড়িতে রাখা বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়।

সেনারা বইসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

সেনারা যেসব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে তার মধ্যে রয়েছে- বেশ কিছু কম্বল (ব্যবহারযোগ্য ও পুরাতন), বই ও কম্বল রাখার বাক্স ছোটবড় ৫টি, আলমারি ১টি, চেয়ার ২৫টি, টেবিল ২টি, খাট ১টি, সোলার প্যানেল (ব্যাটারিসহ), স্টিল ক্যামেরা ১টি, সাউন্ড বক্স ১টি, বাদ্যবাজনা সরঞ্জাম (ছোট-মাঝারি) ড্রামসেট, তবলা ১টি, অ্যালুমিনিয়াম মই ২টি, সিলিং ফ্যান ৩টি, ছোটবড় হাড়িপাতিল ১৫টি, প্লাস্টিক বালতি ৬টি ও সসপেন ৪টি, চাউল ২ বস্তা। এছাড়া চলতি মৌসুমে রোপনের জন্য রাখা বীজ আদা ২ বস্তা, হলুদ ৩ বস্তা, কচু ১০ কেজি, সীমের বীজ ১৫ কেজিসহ ধান কাটার কাঁচি ৪০টি, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি।

তল্লাশিকালে সেখানে উপস্থিত ব্রিগেড কমাণ্ডার শরীফ মো. আমান হাসান গ্রামবাসীদেরকে শাসিয়ে কথা বলতে দেখা যায় মিডিয়ায় প্রচারিত ভিডিওতে। ইউপিডিএফ সংগঠক অংগ্য মারমার নাম উচ্চারণ করে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘অংগ্য মারমা এখাানে থাকে আমাদেরকে কেন তথ্য দেন নাই”। এ নিয়ে তিনি গ্রামবাসীদের ওপর চরম ক্ষোভ ঝাড়েন।

ব্রিগেডিয়ার শরীফ মো. আমান হাসান তার সৈনিকদের সামনে গ্রামের কার্বারীকে (শারীরিকভাবে অসুস্থ) শাসাচ্ছেন।


এদিকে, উক্ত তল্লাশি, ভাঙচুর, লুটপাট ও গ্রামবাসীদের হেনস্থা-হয়রানির ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা।

তিনি সেনাবাহিনী ও সাংবাদিকদের দাবি করা ‘ইউপিডিএফের গোপন আস্তানা’ বিষয়ে বিবৃতিতে বলেন, ইউপিডিএফ একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে গণতান্ত্রিকভাবেই তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইউপিডিএফের গোপন আস্তানা বলে কিছুই নেই। আর মিছিল-মিটিং সভা-সমাবেশ ও পার্টি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ইউপিডিএফ তার দলীয় পতাকা উত্তোলন-প্রদর্শন, লিফলেট বিতরণ, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে থাকে। এসব ডকুমেন্ট বা কাগজপত্র, বই কোন কিছুই গোপনীয় ও নিষিদ্ধ নয়। আর বই-পুস্তক রাখাতো কোনভাবেই অবৈধ কাজ হতে পারে না। বর্তমানে পাড়া-গ্রামে, শহরে প্রত্যেকের বাড়িতে ব্যক্তিগত ও পাড়া-গ্রামে সামাজিক লাইব্রেরি করা হয়ে থাকে এবং সেসব লাইব্রেরিতে নানা ধরনের বই-পুস্তক রাখা হয়।  

বিবৃতিতে ইউপিডিএফ সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, সন্তু গ্রুপের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ৫ শিক্ষার্থীকে উদ্ধারের নামে যেভাবে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ইউপিডিএফের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। এ অভিযানের আড়ালে সন্তু গ্রুপের সাথে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বোঝাপড়ার সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।

তিনি অবিলম্বে এ অভিযান বন্ধ করে সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানান।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More