রাঙামাটি : কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান, চিহ্নিত অপহরণকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও সাজার দাবিতে আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে এগারটার দিকে রাঙামাটি ডিসি অফিসের সম্মুখে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি ও সাজেক নারী সমাজ-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অবস্থান ধর্মঘট সরকারের লেলিয়ে দেয়া চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের হামলার মুখে গুটিয়ে নিতে হয়েছে। কর্মসূচির শুরুর কিছুক্ষণ পর ১০-১২ জন সন্ত্রাসী এসে ধর্মঘট কর্মসূচির ব্যানার ও মাইক কেড়ে নেয়। কয়েক জন ছিল গাঢ় কাল চশমা পরিহিত,এদের মধ্যে বাপ্পি নামের দুর্বৃত্তটি ঢাকার সাভারে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধে ২০১০ সালে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এলাকা থেকে বিতাড়িত। ছাত্র নেতাবেশী অপর সরকারি এজেন্টকেও অনেকে চিনে ফেলেছে। দুর্বৃত্তরা ধর্মঘটের প্ল্যাকার্ডগুলো কেড়ে নিয়ে আছড়ে ভেঙে দেয় (স্মর্তব্য ফেব্রুয়ারিতে মেজর আতিক খাগড়াছড়িতে ভাষা দিবসের প্ল্যাকার্ড ভেঙে নষ্ট করে দিয়েছিল)। এতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিবাদী নেত্রীরা বাধা দিলে সামান্য ধস্তাধস্তিও হয়। দুর্বৃত্তরা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে সমাবেশে চড়াও হয়েছিল। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কর্মীরা তাদের সাথে আর পেরে ওঠে নি।
দুর্বৃত্তদের হামলায় রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভানেত্রী মন্টি চাকমা হাতে গুরুতর আঘাত পান। দীঘিনালা উপজেলা কমিটির সহ:সভানেত্রী চৈতালী চাকমাকে দুর্বৃত্তরা ঘুষি মেরে মাথায় আঘাত করে। দীঘিনালা উপজেলা কমিটির সভানেত্রী এ্যান্টি চাকমাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিতে উদ্যত হয়।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভানেত্রী নিরূপা চাকমাসহ মেনাকী আর নীতিশোভাকে টেক্সিতে তুলে নিতে চাইলে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসী বাপ্পি নিরূপাকে চড় মারতে উদ্যত হলে অপর সহযোদ্ধা মেনাকী চাকমা তৎক্ষণাৎ তাতে বাধা দিয়ে আটকে দিলে দুর্বৃত্তটি আর আঘাত করতে সক্ষম হয় নি। পরে মেনাকী চাকমাকেও দুর্বৃত্তরা টেনে হিঁচড়ে টেক্সিতে উঠায়। নিরূপা চাকমা, মেনাকী ও নীতিশোভা চাকমাকে দুর্বৃত্তরা একটি “বিশেষ ভবনের” সামনে নিয়ে যায়। সেখানে পার্কিং লটে ঘণ্টা খানেকের মতো জিম্মি করে রাখে। এ সময় পিন্টু নামে পরিচয় দানকারী এক ব্যক্তি নিজেকে একটি রাজনৈতিক দলের (বিশেষ গ্রুপ) কর্মী দাবি করে কথা বলেন, তার চোখ ছিল লালচে। তিনি নিরূপা চাকমাসহ হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রীদের পরিচয় জানতে চান। তিনি ‘ডিসি অফিসের সামনে প্রোগ্রাম দিলে শাসকগোষ্ঠীকে উস্কে দেয়ার সামিল হয়’ বলে কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন। তিনি স্বীকার করেন যে, তাদের অনেক ছেলে নিয়ন্ত্রণে নেই এবং ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নিরূপাদের ছেড়ে দেন।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নিরূপা চাকমা জিম্মি দশা থেকে ছাড়া পেয়ে অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ঘটনাটি পুরোপুরি চিহ্নিত অপহরণকারী লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস ও তার গং-কে রক্ষার ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। বারে বারে এমন ঘটনা ঘটছে। আগেও মানিকছড়িতে যখন আমরা প্রোগ্রাম দিই, তখন সেনা মদদে সেটলাররা চড়াও হয়ে সাংবাদিকদের ল্যাপটপ-ক্যামেরা ভেঙে দিয়ে প্রভূত ক্ষতিসাধন করে।
নিরূপা চাকমা আরো বলেন, সকাল ১১ টায় প্রোগ্রাম শুরুর করার কথা। আমরা দেড় শতাধিক কর্মী ডিসি অফিসের সামনে থেকে নান্যাচর-বন্দুকভাঙা আর ভাঙামুরো থেকে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের অপেক্ষায় ছিলাম। সে সব এলাকা থেকে ৭৪ জন কর্মী-সমর্থক ধর্মঘটে অংশ নিতে নদীপথে রওনা হয়েছিলেন। তারা দেরী হওয়ায় আমরা সাড়ে এগারটায় প্রোগ্রাম শুরু করে দিই। সহযোদ্ধা মন্টি প্রারম্ভিক বক্তব্য শুরু করলে দুর্বৃত্তরা এসে পড়ে এবং ডাকাডাকি করে। মুহূর্তের মধ্যে ঘটনা ঘটায়। বোঝা যায় সাজানো ছিল।

তিনি হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পা.চ. নারী সংঘ, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি ও সাজেক নারী সমাজের কর্মীদের সাহসিকতা ও দৃঢ়তার প্রশংসা করে আরও বলেন, আমাকে যখন চড় মারতে উদ্যত হয়, তখন সহযোদ্ধা মেনাকী তা আটকে দেয়। আমাদের সবাইকে তাই হতে হবে। নেতৃত্বকে রক্ষা করার শিক্ষা আমরা পেয়েছি। সন্ত্রাসীরা যখন আমাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছিল তখন কর্মীরা আমাদের ছাড়া ফিরে যাবে না বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়। প্ল্যাকার্ড কেড়ে নিলে পাল্টা টানাটানি করে তা রক্ষা করতে চেয়েছিল। এরা তো মারামারি করার লোক, সরকারের ভাড়া খাটে। ডিউটি পুলিশ ছিল দর্শক সেজে। কোর্ট কাচারিতে উপস্থিত লোকজনও ছিল হতবিহ্বল। কেউ প্রতিবাদে এগিয়ে আসার সাহস দেখায় নি। তবে এ অবস্থা বেশিদিন চলবে না। প্রতিবাদী জনতা একদিন জাগবে। বাঙালি জনগণও তো ’৭১ সালে পাঞ্জাবি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। কল্পনা চাকমা একজন দ্বিতীয় বর্ষের কলেজ ছাত্রী যদি ২০ বছর আগে এত দৃঢ়তা ও সাহস রাখতে পারেন, তাহলে কেন আমরা পিছিয়ে থাকব, কেন আমরা তার সমকক্ষ হতে পারব না? আমাদের পারতেই হবে। রাঙ্গামাটি ডিসি অফিসে আজকে আমরা পরিকল্পনা মত প্রোগ্রাম করতে পারি নি, কিন্তু এতে আমরা দমে যাই নি। আমরা আরো দশগুণ কর্মীবাহিনী নিয়ে বিশাল সমাবেশের ডাক দেবো। সরকারের ভাড়াখাটা দুর্বৃত্তদের পরিণতি হবে রাজাকার আল বদরদের মত। জনগণ তাদের জাতীয় স্বার্থবিরোধী ধ্বংসাত্মক কাজ মুখ বুঁজে সহ্য করবে না। প্রতিরোধের ঢেউ একদিন জোয়ারের মতো গণশত্রুদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

এদিকে রাঙ্গামাটি ডিসি অফিসের সামনে দুর্বৃত্ত কর্তৃক ধর্মঘট বানচালের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন এলাকায় ৪ নারী সংগঠনের নেতা-কর্মীগণ যার যার মতো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। কদুকছড়ি, নান্যাচর, কাউখালি, খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা, মানিকছড়ি ও লক্ষীছড়িতে সাধারণ ছাত্রী ও গৃহীনীরা সরকারের ভাড়াটে দালালদের গালমন্দ করেন এবং বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকে সরকারি লেজুড়দের প্রতি অভিসম্পাতও বর্ষণ করেন।
উল্লেখ্য, কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার অপহরণকারীদের সনাক্ত করা সম্ভব হয় নি, এই মর্মে মামলা খারিজ করে দেয়ার মতামত জানিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিলে তা কল্পনার ভাই কালিন্দি কুমারসহ হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পা.চ. নারী সংঘ, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি ও সাজেক নারী সমাজ তা প্রত্যাখ্যান করে এই অবস্থান কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল।
—————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।