।। পারদর্শী ।।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গত ৫ মে ঢাকায় বাংলা একাডেমীতে গৌরব ৭১ শীর্ষক এক আলোচনায় “পাহাড়ে শান্তি বিনষ্টকারী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না” বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই শান্তি বিনষ্টকারী কারা বা এর জন্য দায়ী কে?
আমরা যদি একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, পাহাড়ে শান্তি বিনষ্টের জন্য দায়ী মূলত রাষ্ট্রের নিয়োজিত বাহিনীর স্বার্থান্বেষী একটি মহল। এই মহলটি চায় না পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ শান্তিতে থাকুক। তারা চায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে স্বার্থ হাসিল করা। সেটা তারা করেই যাচ্ছে অবিরত। আর এখনতো সরকারী নেতাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে খোদ সরকারই পাহাড়ে শান্তি বিনষ্টের জন্য দায়ী। সরকারই মূলত পাহাড়ে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে [নব্য মুখোশ বাহিনী ও তাদের মদদদাতাদের] লালন-পালন করে জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংসের নীতি বাস্তবায়ন করছে। আর এই গোষ্ঠীকে রক্ষা করতেই যেন সরকার এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, সেখানে তো শুধুমাত্র শক্তিমান-বর্মারা মারা যায়নি। মারা গেছে মিঠুন চাকমাসহ অসংখ্য মানুষ। তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতদিন কোথায় ছিলেন? নাকি সরকারী স্বার্থে আঘাত লাগার কারণেই তার এই নড়েচড়ে বসা।
শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন, নড়েচড়ে বসেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীও। আর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নাকি চোখের পানি পর্যন্ত ফেলেছেন শক্তিমানের মৃত্যুর খবর শুনে!! তিনি তো শক্তিমানকে “পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতির একনিষ্ট কর্মী” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কি আশ্চার্য!! তাদের চোখে কি শুধু শক্তিমানরা মানুষ, আর মিঠুনরা মানুষ নয়? এতেই প্রমাণ হয় তারা কাকে দিয়েই জুম্ম ধ্বংসের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।
ক্ষমতাসীন সরকার বোধহয় পাহাড়ের মানুষকে এখনো বোকা ভাবে। মনে রাখা দরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ যুগ যুগ ধরে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে পোড় খেয়ে বেঁচে রয়েছে। তাদেরকে বোকা ভাবলে যে কেউ ভুল করবেন। নিপীড়নের স্টিম রোলার চালিয়ে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লেলিয়ে দিয়ে আন্দোলনকারীদের খুন-অপহরণ করবেন আর যখন স্বার্থে আঘাত লাগবে তখন আপনারা অশান্তি খুঁজে পান। মিঠুন চাকমাকে হত্যাসহ সর্বশেষ দুই নারী নেত্রীকে অপহরণের ঘটনায় তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন। এসব ঘটনা কী তাহলে শান্তির জন্য?
পাহাড়ের মানুষ শান্তি চায়। আর সেটা হতে হবে প্রকৃত শান্তি। কৃত্রিম কোন শান্তি পাহাড়িরা চায় না। মুখে শান্তির কথা বলে পাহাড়ের মানুষকে নিপীড়ন করবেন, নিজ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করবেন, জায়গা-জমি কেড়ে নেবেন আর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে উঠলে বলবেন শান্তি বিনষ্ট করা হচ্ছে–এই দৃষ্টিভঙ্গি কখনো শুভ হতে পারে না।
মনে আছে কি বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়নি তখন পাকিস্তান সরকার এদেশের আন্দোলনকারীদেরও সন্ত্রাসী, শান্তি বিনষ্টকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। পাকিস্তানি কায়দায় আপনারাও পাহাড়ের অধিকারকামী আন্দোলকারীদেরকে ‘শান্তি বিনষ্টকারী’ বলছেন, সন্ত্রাসী বলছেন। এই ধারণা কখনো শান্তির পথে সহায়ক নয়। এটা বরং পাহাড়ের মানুষকে আরো বেশি দূরত্বে ঠেলে দেওয়ার সামিল। এতে করে পরিস্থিতি আরো জটিল থেকে জটিলতার দিকেই ধাবিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এদিকে, শক্তিমান, বর্মাসহ ৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরেই পাহাড়ে চলছে যৌথ বাহিনীর সাড়াশি অভিযান। এই অভিযানে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাদ যাচ্ছে না জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান, কার্বারীরাও। সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী বিশেষ একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে রক্ষায় চলা এই অভিযানে কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় এ নিয়েই মানুষের মধ্যে এখন চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরকারের উচিত এ ধরনের দমনমূলক অভিযান বন্ধ করে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দূর করা এবং পাহাড়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সকল পক্ষের সাথে আলোচনায় এগিয়ে আসা। এটা না করে যদি নিপীড়ন চালিয়ে পরিস্থিতি উত্তরণের চেষ্টা করা হয় তাহলে জনগণের মধ্যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা দিলে তাতে কারোর জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখকের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]
——————
সিএইচটিনিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্রউল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।