লিখেছেন : নিগিরা ধন চাকমা
[নিগিরা ধন চাকমার ফেসবুক নোটটি এখানে হুবহু প্রকাশ করা হলো]
ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক নিপীড়ন বহুগুণ বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিন ‘আঞ্চলিক’ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা কর্মীরা গ্রেফতারের শিকার হচ্ছে। তবে আরো লক্ষ্য করার বিষয় সংস্কারবাদীদের কাউকে এ যাবত গ্রেফতার করা হয়নি। যদিও তাদের বিরুদ্ধেও অনেক মামলা রয়েছে।
বান্দরবানের রুমায় গত পরশু অর্থাৎ ১৭ মে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দুই স্থানীয় নেতাকে নিরাপত্তা বাহিনী আটক করে চাঁদাবাজির অভিযোগে। আসলে তারা তাদের সংগঠনের ২০ মে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসুচি পালনের জন্য কুপনে চাঁদা সংগ্রহ করছিলেন। প্রশ্ন হলো, এভাবে চাঁদা উত্তোলন কি আইনত অপরাধ?
আমি আইনের ছাত্র নই। বাংলাদেশের আইনে চাঁদাবাজির কোন সংজ্ঞা দেয়া আছে কী না বা দেয়া থাকলে তার আওতা বা পরিধি কী তা আমার জানা নেই। তবে সাধারণ জ্ঞানে বলা যায় জোর জবরদস্তি না করে কারো কাছ থেকে কোন বৈধ সংগঠনের নামে অর্থ সাহায্য চাওয়া হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে না। দেশের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা কী আওয়ামী লীগ, বিএনপির পার্টি তহবিলে লক্ষ লক্ষ টাকার চাঁদা দেয় না? আমেরিকাতেও তো রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের দেয়া চাঁদায় চলে। তাহলে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে বা আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য যা অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না, তা পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘আঞ্চলিক’ রাজনৈতিক দলগুলোর বেলায় অপরাধ বলে গণ্য হবে কেন?
পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনের শাসন থাকলে এসব অন্যায় গ্রেফতার নির্যাতন হতো না। আমি আইনের ছাত্র না হলেও বাংলাদেশ সংবিধান পড়েছি এবং একটি কর্মশালায় এ সংবিধান সম্পর্কে একটি সুন্দর আলোচনা শুনেছি। আসলে সংবিধানে নাগরিকদের জন্য মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে। যেমন সংগঠন করার অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, নিজ গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার ইত্যাদি।
কিন্তু এই মৌলিক অধিকার কি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ভোগ করছে? কত জন পাহাড়ি বা জুম্ম জানে দেশের সংবিধানে তাদের কী কী অধিকার আছে? সংবিধানের ৪৩ ধারায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার দেয়া আছে। এতে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা নিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে।’ কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা দেখতে পায় প্রায় প্রতিদিন কোন ধরনের আইনী নোটিশ ছাড়া তাদের ঘরবাড়িতে তল্লাশী করা হচ্ছে, বাড়ির লোকজনকে হয়রানি করা হচ্ছে।
এক কথায় পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন আইনের শাসন নেই, আছে শক্তির, পেশির শাসন। পেশিশক্তিই এখানে আইন। এই অবস্থা চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে বাধ্য। রাজনৈতিক সমস্যা যদি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা না হয় এবং সে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যদি অরাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে দেয়া হয়, তাহলে তার অর্থ হলো অপারেশন থিয়েটারে রোগীর অপারেশনের বা চিকিৎসার দায়িত্ব অভিজ্ঞ ডাক্তারের হাতে না দিয়ে একজন ডাক্তারী না জানা অজ্ঞ লোকের হাতে দেয়া। এতে রোগী মারা যাবেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশক ধরে চলা সশস্ত্র বিদ্রোহ বন্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ ছাড়া ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আদৌ হতে পারতো কী না সন্দেহ থেকে যায়। তাই আমরা যদি চাই পাহাড়ের পরিস্থিতি চুক্তি-পূর্ব অবস্থায় ফিরে না যাক, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনের দায়িত্বভার অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে দিতে হবে এবং প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এর কোন বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন জারি রেখে, পাহাড়ি মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশ কখনোই একটি উন্নত দেশে পরিণত হতে পারবে না। এ সত্য সরকারকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে।
নিগিরা ধন চাকমা
১৯ মে ২০১৮
————————-
সিএইচটিনিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।