
সিএইচটি নিউজ ডেস্ক ।। আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশে দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়।
আজকের দিনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনকারী নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা দিবসও। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার আজ ৩৪তম বার্ষিকী।
নারী দিবস নিয়ে সংক্ষিপ্ত কথা
নারী দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে মজুরী বৈষম্য ও কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এবং কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করার দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় নেমেছিলেন সূতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে সরকার-মদদপুষ্ট লাঠিয়াল বাহিনী চালায় দমনপীড়ন।
১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী নিউইয়র্কে প্রথম নারী দিবস পালন করা হয়, সোস্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা ১৯০৮ সালের আন্তর্জাতিক নারী পোষাক শ্রমিক সংঘের (International Ladies’ Garment Workers’ Union) ধর্মঘটের স্মরণে এর আয়োজন করে। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে একটি আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন আয়োজন করা হয়। উক্ত সম্মেলনে জার্মান সমাজতন্ত্রী লুইস জাইটস (Luise Zietz) অংশতঃ আমেরিকান সমাজতন্ত্রীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব দেন এবং তার সহযোদ্ধা সমাজতন্ত্রী ক্লারা জেটকিন (Clara Zetkin, যিনি পরে কমিউনিস্ট নেত্রী হন) উক্ত প্রস্তাব সমর্থন করেন। সম্মেলনে উপস্থিত ১৭টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি উক্ত প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন, তবে দিবসটি পালনের নির্দিষ্ট কোন তারিখ ঠিক করা হয়নি।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ প্রথম বারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় এবং অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানী ও সুইজারল্যান্ডে ১০ লক্ষ নারী পুরুষ এতে অংশ নেন। কেবল অস্ট্রে-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যে ৩০০টি র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। ভিয়েনায় নারীরা মিছিল করেন এবং প্যারী কমিউনের শহীদদের সম্মানে ব্যানার প্রদর্শন করেন। নারীরা ভোটাধিকার ও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবার দাবি জানান। তারা লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানান। অপরদিকে আমেরিকান নারীরা তাদের জাতীয় নারী দিবস প্রতি ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ রবিবার পালন অব্যাহত রাখেন। ১৯১৩ সালে রাশিয়ান নারীরা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ শনিবার প্রথম বারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেন। ১৯১৪ সালে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় এবং সেই পর থেকে প্রতি বছর প্রত্যেক দেশে ৮ মার্চ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সেই বছর দিবসটি উদযাপনের সময় জার্মানীতে নারীদের ভোটাধিকারের দাবি জানানো হয়। লণ্ডনে নারী ভোটাধিকারের সমর্থনে ৮ মার্চ বো থেকে ট্রাফালগার স্কোয়ারে একটি মিছিল বের করা হয়। সিলভিয়া পেংকহার্স্ট (Sylvia Pankhurst)) ট্রাফালগার স্কোয়ারে বক্তব্য দিতে গেলে তাকে চারিং ক্রস স্টেশন থেকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯১৭ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের দিন বিক্ষোভ আয়োজনের মাধ্যমে মহান ফেব্রুয়ারী বিপ্লব শুরু হয়। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর বলশেভিক নেতা আলেকজান্দ্রা কোলন্তাই এবং ভ্লাদিমির লেনিন সোভিয়েট রাশিয়ায় ৮ মার্চকে সরকারী ছুটি হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপর তৎকালীন কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাশিয়াকে অনুসরণ করে দিনটি ছুটি হিসেবে পালিত হয়। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চীনে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠার পর সে দেশে ৮ মার্চকে ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ইউএন ডে অব ওমেনস রাইটস এন্ড ওয়ার্ল্ড পিস (জাতিসংঘ নারী অধিকার ও বিশ্ব শান্তি দিবস) ঘোষণা করে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দিবসটি পালনের আহ্বান জানায়।
বাংলাদেশে নারী দিবস পালিত হলেও, সরকার প্রধান একজন নারী হলেও, এদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা রোধে সরকারের উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়।
দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সভ্য দেশে বিরল। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণের বীভৎস রূপ দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২১ সালে ৩ হাজার ৭০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অপরদিকে, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর এক প্রতিবেদনে গত বছর ১৬৩৭ জন নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর চলতি বছর (২০২২) জানুয়ারিতে ২৭২ জন নারী ও কন্যাশিশু এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ২৬৫ জন নারী ও শিশু (কন্যা) নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে গত বছর (২০২১) অন্তত ২৯ জন পাহাড়ি নারী ও শিশু ধর্ষণসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে ইউপিডিএফ-এর বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অতি সম্প্রতি গত ৩ মার্চ বান্দরবানে এক পাহাড়ি নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর কুপিয়ে হত্যার ঘটনা বিভিন্ন মিডিয়ার প্রকাশিত হয়েছে।
প্রকৃত অর্থে গোটা দেশে নারী নির্যাতনের যে পরিসংখ্যান বিভিন্ন রিপোর্টে তুলে ধরা হয়ে থাকে এ সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি হতে পারে। এমন অনেক ঘটনা ঘটে নানা কারণে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় না এবং এসব ঘটনায় কোন মামলাও হয় না। তারপরও প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাংলাদেশে কী মাত্রায় নারী নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস তখনই স্বার্থক ও সফল হবে যখন সমাজে নারী প্রতি বৈষম্য, খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি দূর হবে এবং নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ সব ধরনের সহিংহতা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
৮ মার্চ হিল উইমেন্স ফেডারেশনে প্রতিষ্ঠা দিবসও। সংগঠনটির আজ ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৮৮ সালের এদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক জন অগ্রসর পাহাড়ি নারী শিক্ষার্থী এই সংগঠনটি গঠন করেন। তবে মূলত তৎকালীন ছাত্র নেতা ও বর্তমান ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত খীসা এই সংগঠনটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

শুরুতে এই সংগঠনটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকায় থাকলেও তৎসময়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার কর্তৃক পাহাড়ি জনগণের উপর অবর্ণনীয় অন্যায়-অত্যাচার, দমন-পীড়ন, নারীদের ধর্ষণ-শ্লীলতাহানীর প্রতিবাদে সংগঠনটি রাজনৈতিক সংগঠনে রূপ লাভ করে। ১৯৯৫ সালে খাগড়াছড়িতে সংগঠনটির ১ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর বেইজিং-এ বিশ্ব নারী সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা সেনা কমাণ্ডার লে. ফেরদৌস গং দ্বারা অপহৃত হলে এর প্রতিবাদে হিল উইমেন্স ফেডারেশন সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। এতে করে সংগঠনটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি প্রতিবাদী নারী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়।শুরুতে রুতে এই সংগঠনটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকায় থাকলেও তৎসময়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার কর্তৃক পাহাড়ি জনগণের উপর অবর্ণনীয় অন্যায়-অত্যাচার, দমন-পীড়ন, নারীদের ধর্ষণ-শ্লীলতাহানীর প্রতিবাদে সংগঠনটি রাজনৈতিক সংগঠনে রূপ লাভ করে। ১৯৯৫ সালে খাগড়াছড়িতে সংগঠনটির ১ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর বেইজিং-এ বিশ্ব নারী সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা সেনা কমাণ্ডার লে. ফেরদৌস গং দ্বারা অপহৃত হলে এর প্রতিবাদে হিল উইমেন্স ফেডারেশন সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। এতে করে সংগঠনটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি প্রতিবাদী নারী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়।
হিল উইমেন্স ফেডারেশন বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে লড়াকু সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম সংগঠনে পরিণত হয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এ সংগঠনটি নারী নির্যাতন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন