অসলো চুক্তির পর ফিলিস্তিনীরা কেমন আছেন?

0
24

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক
সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় হোয়াইট হাউসে চুক্তি স্বাক্ষরের পর ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত (ডানে) ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন (বাঁয়ে) করমর্দন করছেন। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩। ছবি: সংগৃহিত

গত ১৩ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক অসলো চুক্তির ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে। ১৯৯৩ সালের এদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের সাউট লনে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) ও ইসরায়েলের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। একে আনুষ্ঠানিকভাবে Declaration of Principles on Interim Self-Government Arrangements বা সংক্ষেপে Declaration of Principles আখ্যায়িত করা হয়। এটি ছিল পাঁচ বছরের জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা, চূড়ান্ত বোঝাপড়া ১৯৯৯ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা ছিল। চুক্তির মাধ্যমে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার প্রধান প্রধান শহর ও শহরতলীর নিয়ন্ত্রণ একই চুক্তির বলে গঠিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (Palestinian Authority or PA) কাছে হস্তান্তর করা হয়।

চুক্তি স্বাক্ষরের প্রথম দিকে ৭০ শতাংশ ফিলিস্তিনী অসলো চুক্তিকে সমর্থন করেছিলেন, ৩০ বছর পর এখন মাত্র এক তৃতীয়াংশ এই চুক্তির সমর্থক। তখন অনেকে বলেছিল এই চুক্তি সঠিক লক্ষ্যের দিকে একটি সঠিক পদক্ষেপ। কিন্তু পরে দেখা গেছে ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে দখলকৃত জমিতে তার বেআইনী বসতিস্থাপন কার্যক্রম বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে এই চুক্তিকে ব্যবহার করছে। ফলে তাদের আশা এখন হতাশায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশের অভিমত হলো ৩০ বছর আগে ফিলিস্তিনী নেতারা বড় ধরনের ভুল করেছিলেন। ফিলিস্তিনীদের জীবন এখন ইসরায়েলী সামরিক দখলের অধীনে জর্জরিত। প্যালেস্টাইনের ডি ফেক্টো রাজধানী রামাল্লা থেকে তারা যেদিকেই বের হয়ে যান না কেন, তাদেরকে সব সময় ইসরায়েলি চেকপোস্ট, সৈন্য ও বসতির মুখোমুখি হতে হয়। অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেটেলারদের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ১০ হাজার। এখন তাদের সংখ্যা সাত লক্ষেরও বেশি। অর্থাৎ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতিস্থাপন ৩ গুণ বেড়েছে। অধিকন্তু ইসরায়েল এখনও ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ডে বেআইনী বসতিস্থাপন অব্যাহত রেখেছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, নিরীহ শিশু কিশোরসহ আন্দোলনকারীদের হত্যা করছে এবং ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। স্থল, সমুদ্র ও আকাশ পথে গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে।

অসলো চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। ছবি: সংগৃহিত

ফিলিস্তিনীরা পিএলও-র ফাতাহ দলের নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) ওপরও ক্ষুদ্ধ। পিএ হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের মতো একটি সংস্থা, তবে অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন: পিএর নিজস্ব পুলিশ বাহিনী রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য পাসপোর্ট ইস্যু করতে পারে। পিএর ওপর ফিলিস্তিনীদের ক্ষুদ্ধ হওয়ার কারণ হলো অনেক। প্রথমত, এর নেতারা অত্যন্ত দুর্বল এবং উদ্যোগহীন, তারা ইসরায়েলের ফিলিস্তিনী ভূমি দখলের বিরুদ্ধে কিছুই করে না। দ্বিতীয়ত তারা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং কর্তৃত্বপরায়ণ; এমনকি তাদেরকে ইসরায়েলি দখলদারের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। তৃতীয়ত, পিএ ফিলিস্তিনীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সহযোগিতা ও সমন্বয় করে থাকে। সাধারণ ফিলিস্তিনীরা আরও লক্ষ্য করেন যে, পিএর কর্তাব্যক্তিরা উচ্চ বেতন ভোগ করেন এবং ইসরায়েলের ভিআইপির ভ্রমণ পাস পেয়ে থাকেন, যার ফলে তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ইসরায়েলি ভ্রমণ সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ শিথিল করা হয়। পশ্চিম তীরে ইসরায়েল নিরাপত্তা দেয়াল নির্মাণের নামে ফিলিস্তিনীদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এবং তাদের ভূমি বেদখল করেছে। এসব কারণে ৬০ শতাংশ ফিলিস্তিনী পিএ-কে একটি বোঝা বলে মনে করেন। এমনকি ছয় মাস আগে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মনে করতেন যে, পিএ ধ্বসে পড়লে বরং তা ফিলিস্তিনী জাতীয় স্বার্থে ভালোই হবে।

ইসলাইলি হামলার থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনীরা। ছবি: সংগৃহিত

অসলো চুক্তি আসলে দু’টি। একটি ১৯৯৩ সালে এবং অন্যটি ১৯৯৫ সালে স্বাক্ষরিত হয়। শেষোক্ত চুক্তির ফলে ইসরায়েলি অধিকৃত পশ্চিম তীরকে তিনটি পরস্পর বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে ভাগ করা হয়: অঞ্চল ‘এ’, অঞ্চল ‘বি’ এবং অঞ্চল ‘সি’। ‘এ’ অঞ্চল প্রথমদিকে পশ্চিম তীরের ৩ শতাংশ নিয়ে গঠিত ছিল, ১৯৯৯ সালের দিকে তা বেড়ে ১৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। এই ‘এ’ অঞ্চলে পিএ অধিকাংশ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। ‘বি’ অঞ্চল পশ্চিম তীরের ২১ শতাংশ নিয়ে গঠিত। এ ও বি অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি পিএ-র এক্তিয়ারভুক্ত। তবে এখানে এক্সটার্নেল সিকিউরিটি বা বহিঃ নিরাপত্তার ওপর ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যার অর্থ হলো ইসরায়েলি বাহিনীর যখন ইচ্ছা তখন অঞ্চল ‘এ’ ও ‘বি’তে প্রবেশের অধিকার রয়েছে — সচরাচর কাউকে আটক করতে অথবা অনেক সময় বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড চালাতে তারা সেখানে প্রবেশ করে থাকে। ‘সি’ অঞ্চল পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ নিয়ে গঠিত। অসলো চুক্তি অনুসারে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পিএ-র কাছে সমর্পন করার কথা ছিল। কিন্তু ইসরায়েল এখনও নিরাপত্তা, পরিকল্পনা ও নির্মাণসহ সকল বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।

ফিলিস্তিনী নেতা মোস্তফা বারগুটি অসলো চুক্তিকে একটি ফাঁদ বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ এই চুক্তি ফিলিস্তিনী ভূখেণ্ডে ইসরায়েলি সামরিক দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে পারেনি। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল জর্দান ও মিশর থেকে পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করেছিল। তারপর থেকেই ৫৬ বছর ধরে ইসরায়েল তা ধরে রেখেছে। ফলে চুক্তি স্বাক্ষরের ৩০ বছর পর ফিলিস্তিনীদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন অধরাই থেকে গেছে। এছাড়া আরও যেসব বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়েছে সেগুলো হলো: জেরুজালেম শহরের ভবিষ্যত, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি বসতি, ফিলিস্তিনী শরণার্থীদের স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবর্তন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা।

অসলো চুক্তি বলতে গেলে এখন মৃত। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় ইনতিফাদা বা ফিলিস্তিনী অভ্যুত্থানের সময় এই চুক্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আমেরিকার মধ্যস্থতায় পরে দুই পক্ষের মধ্যে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য আরও তিন বার আলোচনা হয়, তবে তাতে কিছুই অর্জিত হয়নি। ২০১৪ সালে তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত শেষ বৈঠকটি কোন ধরনের সমঝোতা ছাড়া ভেঙে যায়। #


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.