প্রয়াত ইউপিডিএফ নেতা শান্তিদেব চাকমা’র স্মরণে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত

শান্তিদেব চাকমার আদর্শ অনুসরণ করে সব রাজনৈতিক দলকে হানাহানি, মারামারি ভুলে যেতে হবে: বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির

0
76

রাঙামাটি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৩

সদ্য প্রয়াত ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় সদস্য ও রাঙামাটি জেলা ইউনিটের প্রধান সংগঠক শান্তিদেব চাকমা’র সাপ্তাহিক ক্রিয়া উপলক্ষে ধর্মীয় পুন্যানুষ্ঠান ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ সোমবার (৩০ অক্টোবর ২০২৩) প্রয়াত শান্তিদেব চাকমার গ্রামের বাড়ি রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের তিবিরেছড়ায় পরিবারবর্গ ও ইউপিডিএফের রাঙামাটি জেলা ইউনিটের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রথমে ধর্মীয় পুন্যানুষ্ঠান ও পরে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।

সকাল ৮টা সময়ে ভিক্ষুসংঘের মঞ্চে আসন গ্রহনের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান শুরু হয়।

শুরুতে প্রয়াত ইউপিডিএফ নেতা শান্তিদেব চাকমার সংগ্রামী জীবন নিয়ে শিল্পী জোনাকী চাকমা সংগীত পরিবেশনের পর পঞ্চশীল গ্রহনের মধ্যে দিয়ে বুদ্ধ মুর্তি দান, সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান, হাজার প্রদীপ দানসহ নানাবিধ দানের অনুষ্ঠান উৎসর্গ করা হয়।

এরপর শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন প্রয়াত শান্তিদেব চাকমার একমাত্র কন্যা ভিক্টোরি চাকমা।

ধর্মীয় অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইউপিডিএফ সংগঠক চন্দন চাকমা। এতে ধর্মীয় দেশনা প্রদান করেন, নান্যাচর রত্নাংকুর বন বিহারের অধ্যক্ষ বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির, পরিচুগ অরন্য কুটির অধ্যক্ষ সারিপুত্র মহাস্থবির, মরিশ্যাবিল বন বিহারের অধ্যক্ষ জিনপ্রিয় মহাস্থবির, যমচুগ বন বিহারের অধ্যক্ষ কল্যান জ্যোতি মহাস্থবির প্রমুখ।

এছাড়া ধর্মীয় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন বোধিপুর বন বিহারের অধ্যক্ষ জিন বোধি মহাস্থবিরসহ রাজবন বিহার, বৈশালীনগর বন বিহার, ত্রিরত্নাংকুর বন বিহার বিহার ও বিভিন্ন শাখা বিহার থেকে ৭০ জনের অধিক ভিক্ষু, শ্রামণ।

ধর্মীয় দেশনায় মরিশ্যাবিল বন বিহারের অধ্যক্ষ জিনপ্রিয় মহাস্থবির বলেন, ধর্মীয় নীতি, সমাজনীতি কিংবা রাজনীতি বলেন ঐক্যবদ্ধ ছাড়া কোনকিছু সফল হওয়া যায় না। তিনি বলেন, বুদ্ধ তার বোধিসত্ব জীবনেও রাজনীতি করেছেন কিন্তু তিনি কখনো কাউকে অন্যায় করেননি। তিনি সকল প্রানীর সুখের জন্য রাজনীতি করেছেন। এসময় তিনি প্রয়াত ইউপিডিএফ নেতা শান্তিদেব চাকমাকে একজন ধার্মিক ও জনগনের মুক্তির সংগ্রামে আদর্শ সৈনিক হিসাবে উল্লেখ করেন।

নান্যাচর রত্নাংকুর বন বিহারের অধ্যক্ষ বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির তার ধর্মীয় দেশনায় বলেন, শান্তিদেব চাকমার আদর্শ অনুসরণ করে সব রাজনৈতিক দলকে মারামারি, হানাহানি ভুলে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, বুদ্ধ বলেছিলেন স্বজাতির ছায়া ছাড়া স্বধর্ম রক্ষা হয় না। তাই স্বজাতি ও স্বধর্ম রক্ষার জন্য সবাইকে হানাহানি, মারামারির পথ ত্যাগ করা দরকার।

ধর্মীয় সভা শেষে ইউপিডিএফের রাঙামাটি জেলা ইউনিটের উদ্যোগে প্রয়াত শান্তিদেব চাকমার স্মরণে এক স্মরনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন ইউপিডিএফের নান্যাচর ইউনিটের প্রধান সংগঠক সুকীর্তি চাকমা ও সঞ্চালনা করেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিলাস চাকমা। এতে আরো বক্তব্য রাখেন বন্দুকভাঙা ইউপি চেয়ারম্যান অমর চাকমা ও প্রয়াত শান্তিদেব চাকমার সহধর্মিনী জিনা চাকমা প্রমুখ। এছাড়া মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রাঙামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়তন চাকমা, ২ নং নানিয়ারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাপ্পী চাকমা ও কাউখালি উপজেলার ২নং ফটিকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ঊষাতন চাকমা।

সভা শুরুর পূর্বে প্রয়াত শান্তিদেব চাকমার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ইউপিডিএফের পক্ষে সুকীর্তি চাকমা ও শান্তিময় চাকমা, পরিবারের পক্ষ থেকে প্রয়াত শান্তিদেব চাকমার সহধর্মিণী জিনা চাকমা ও একমাত্র কন্যা ভিক্টোরি চাকমা। এছাড়া নির্বাচিত জুম্ম জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন ক্লাব, সমিতি, বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ফুল দিয়ে প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

স্মরণসভা শুরুতে প্রয়াত শান্তিদেব চাকমা প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

এরপর ইউপিডিএফ সভাপতি ও সম্পাদকের শোক বার্তা পড়ে শোনান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙামাটি জেলা সভাপতি রিমি চাকমা ও ইউপিডিএফ নেতা শান্তিময় চাকমা।

শোকবার্তায় ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা শান্তিদেব চাকমার অকাল প্রয়াণে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে গভীর দুঃখ ও শোক প্রকাশ করেন এবং তার স্মৃতির প্রতি গভীর সম্মান জানান। বার্তায় তিনি শোক সন্তপ্ত স্ত্রী-কন্যা, পরিবারের সদস্যবর্গ, আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসীর প্রতি জানাচ্ছে গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

শান্তিদেব চাকমার স্মৃতিচারণ করে শোক বার্তায় প্রসিত বিকাশ খীসা আরো বলেন, শান্তিদেব চাকমা নির্যাতিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কলেজ জীবনে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করেছেন। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ গঠিত হলে তাকে যুক্ত হয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তার মৃত্যুতে ইউপিডিএফ একজন বিশ্বস্ত বন্ধু সহযোদ্ধাকে হারালো। বন্দুকভাঙাবাসী হারিয়েছে এলাকার এক দেশপ্রেমিক সুযোগ্য সন্তানকে। জনগণের মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে ভবিষ্যতে বন্দুকভাঙা অঞ্চল থেকে শান্তিদেব চাকমার মতো আরও অনেক দেশপ্রেমিক সুযোগ্য সন্তান গড়ে উঠবে বলে ইউপিডিএফ প্রত্যাশা করে।

স্মরণসভায় বন্দুকভাঙা ইউপি চেয়ারম্যান অমর চাকমা বলেন, শান্তিদেব চাকমার অকাল মৃত্যুতে আমাদের একটি হাত ভেঙে যাওয়ার মতো হয়েছে। তাঁকে হারানোর ফলে জনগণ ও পার্টির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

সভার সভাপতি সুকীতি চাকমা বলেন, শান্তিদেব চাকমার অকাল প্রয়াণে পার্টি ও জনগণ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এক যোগ্য নেতাকে হারিয়েছে। আমাদেরকে তাঁর মুত্যু শোককে শক্তিতে পরিণত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেগবান করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, শান্তিদেব চাকমা আমৃত্যু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। তিনি ভূমি বেদখল, অন্যায় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে ছাত্র-যুব-নারী সমাজসহ জনগণকে সংগঠিত করেছেন। দীঘিনালায় সাধনাটিলার জমি রক্ষায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন।

সুকীর্তি চাকমা বলেন, শাসকগোষ্ঠি আজ ইউপিডিএফের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমনে মরিয়া প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে শত দমন-পীড়ন চালিয়েও ইউপিডিএফকে দমিয়ে রাখা যায়নি। কারণ ইউপিডিএফ কঠিন পরিস্থিতি ও সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

তিনি প্রয়াত শান্তিদেব চাকমার চেতনা-আদর্শকে ধারণ করে আগামী দিনে জুম্মো জনগণের মুক্তির সংগ্রাম বেগবান করার জন্য ইউপিডিএফের প্রদর্শিত পথে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান।

শান্তিদেব চাকমার সহধর্মিণী জিনা চাকমা বলেন, যারা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি প্রয়াত শান্তিদেব চাকমার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করার আহ্বান জানান।

স্মরনসভা শেষে প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড একটি প্রতিবাদী নাটিকা প্রদর্শন করে।

অনুষ্ঠানে বন্দুকভাঙা এলাকাবাসী ছাড়াও দীঘিনালা, কুদুকছড়ি, কাউখালী, লংগুদু, নান্যাচর, রাঙামাটি সদর উপজেলা থেকে জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়-স্বজনসহ দুই হাজারের অধিক লোকজন অংশগ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য, গত ২০ অক্টোবর দিবাগত রাতে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইউপিডিএফ নেতা শান্তিদেব চাকমা প্রয়াত হন।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.