নিজস্ব প্রতিবেদক
সিএইচটিনিউজ.কম

সংবিধানের চরম বৈষম্যমূলক, জাতি বিদ্বেষী ও ফ্যাসিবাদী পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল এবং বাংলাদেশের সকল সংখ্যালঘু জাতি ও ভাষাভাষীর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে ‘জাতিসত্তা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ‘-এর উদ্যোগে সংগঠনের সভাপতি এস. সি. আলবার্ট সরেন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বলস্মৃতি চাকমা, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ডাঃ ফয়জুল হাকিম, সান্তাল জাতির প্রতিনিধি চুড়কা মার্ডি, মুন্ডা জাতির প্রতিনিধি কুরশীদ মার্ডি, ওরাও জাতির প্রতিনিধি দিনোমনি তিগ্যা, মনিপুরী জাতির প্রতিনিধি ভীমপল সিন্হা, চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধি পরিমল বাড়াইক, উর্দুভাষীদের প্রতিনিধি খালেদ হোসেন, ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমা, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় কমিটির যুগ্মসম্পাদক ডঃ হাসিবুর রহমান, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি কনিকা দেওয়ান, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা, টেকনাফ আমতলী চাকমা পল্লীর প্রতিনিধি মনিস্বপন চাকমা ও অদিকা চাকমা, নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চার যুগ্ম আহ্বায়ক জাফর হোসেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের আহ্বায়ক মাসুদ খান, জুয়েল হোসেন, ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান প্রমুখ।
সভাপতি এস. সি. আলবার্ট সরেন বলেন, “৩০ জুন হুল দিবস, সান্তাল বিদ্রোহের ১৫৭ তম বার্ষিকী; ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক দিবস। ২০১১ সালের এই ৩০ জুন আবার বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতি সমূহের জন্য একটি কালো দিবস। এই দিন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫এর অধিক ভিন্ন ভাষা-ভাষী জাতির অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে সাংবিধানিকভাবে তাদের জাতিগত পরিচয় নির্ধারন করা হয়েছে ‘বাঙালী‘ হিসেবে। শুধু তাই নয় বাঙালী ভিন্ন অপরাপর জাতি ও ভাষাভাষী জনগণকে হেয় ও অবজ্ঞা করে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী‘ হিসেবে অভিহিত করে তাঁদের মর্যাদাহীন ও চরমভাবে অপমানিত করা হয়েছে। বৃহৎ জাতিসুলভ জাত্যাভিমান থেকেই দেশের অন্যান্য জাতিসমূহকে অস্বীকার করা হয়েছে যা জাতিগত ফ্যাসিবাদেরই নামান্ত্মর। সংবিধান সংশোধনের জন্য হুল দিবস বেছে নেয়া হয়েছিল সচেতনভাবে। এর মাধ্যমে হুল দিবস ও ব্রিটিশ বিরোধী গণসংগ্রামকে অস্বীকার ও তার মর্যাদাহানি ঘটানো হয়েছে।”
সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বলস্মৃতি চাকমা বলেন, “রাষ্ট্র কর্তৃক ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদানের মাধ্যমে রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবেই সাম্প্রদায়িক রূপ লাভ করেছে। একদিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ‘বিস্মিলস্নাহির-রাহ্মানির রহিম‘ রেখে অন্যদিকে (১১ নং ধারায়) ‘রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান‘ বিলোপের কথা বলা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। সকল নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ঐক্য সংহতি স্থাপন করাই একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু সরকার পরিকল্পিতভাবে জনগণকে বিভক্ত করতে চাইছে।”
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, “পঞ্চদশ সংশোধনী দেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত্তি মজবুত করেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭(খ) ধারায় নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের দাবি, সংবিধানের যে কোন সমালোচনা এমনকি সাংবিধানিক সংস্কারের দাবিও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করবার মতা সরকার ও রাষ্ট্রকে প্রদান করা হয়েছে। সংশোধিত ৩৮ ধারায় নাগরিকদের সংগঠন করার অধিকার খর্ব করা হয়েছে এবং যে কোন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত বিশেষতঃ বাম প্রগতিশীল দল ও সংগঠনসমূহের কার্যকলাপকে সরকার খেয়াল খুশিমত সংবিধানের পরিপন্থী ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করতে পারবে। তিনি বলেন, বর্তমান সংবিধান জনগণের স্বার্থরায় ব্যর্থ এক অকেজো দলিল। জনগণের হাতে মতা আনতে, নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে এবং নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান কায়েমে শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত জাতিসমূহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।”
সমাবেশ থেকে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, বাংলাদেশের সকল সংখ্যালঘু জাতি ও ভাষাভাষীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতি ও ভাষাভাষী জনগণের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা চিহ্নিত করা ও সমাধানে করণীয় নির্ধারণে ‘জাতিসত্তা কমিশন‘ গঠনের দাবি জানানো হয়।
এ ছাড়া সারাদেশে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের ভূমি বেদখল বন্ধ, ভূমি ও জলাশয়ের উপর সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রথাগত অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান, চা-জনগোষ্ঠীকে স্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত্মী প্রদান, ক্যাম্পে বসবাসরত উর্দুভাষীদের পাসপোর্ট প্রদান ও ক্যাম্প থেকে উচ্ছেদ বন্ধ, জাতীয় উদ্যান, ইকোপার্ক, সাফারী পার্ক, রিজার্ভ ফরেস্ট ও সামাজিক বনায়নের নামে বনাঞ্চল হতে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা উচ্ছেদ বন্ধ, আলফ্রেড সরেন, পিরেন স্নাল ও চলেশ রিছিল হত্যাকান্ড, কল্পনা চাকমা গুম এবং লোগাঙ-লংগদু-নান্যাচর গণহত্যার শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানানো হয়।
সমাবেশে এসব দাবি আদায়ে সারা দেশ জুড়ে তিন মাসব্যাপী সভা, সমাবেশ ও গণসংযোগ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়।
সমাবেশ শেষে একটি বিশাল মিছিল প্রেসক্লাব, পল্টন মোড়, বায়তুল মোকররম ঘুরে আবার প্রেসক্লাবে এসে শেষ হয়।