নিজস্ব প্রতিবেদক
সিএইচটনিউজ.কম

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চলমান শুনানি, টেকনাফে চাকমা পল্লীতে হামলা ও উত্তরবঙ্গে সংখ্যালঘু জাতির ৪ জনকে হত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে আজ ২৪ জুন ২০১২ রবিবার ঢাকায় সেগুন বাগিচাস্থ রিপোটার্স ইউনিটি সম্প্রসারিত হল রুমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ কথা বলেন।
লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি নতুন কুমার চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী একতরফাভাবে ও স্বৈরাচারী কায়দায় কমিশনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। গত ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই নিয়োগ লাভের পরপরই তিনি কমিশনের অন্য সদস্যদের মতামত না নিয়ে ভূমি জরিপ শুরু করার ঘোষণা দেন, যা সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। কারণ ভূমি কমিশন আইনের কোথাও তাকে ভূমি জরিপের ম্যান্ডেট দেয়া হয়নি। পরে প্রবল প্রতিবাদ ও বিরোধিতার মুখে তিনি উক্ত মনগড়া সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হন। ২০১০ সালের ১৪ মার্চ বিতর্কিত ভূমি কমিশন আইনের সংশোধন ছাড়া কমিশনের বাকি সদস্যদের মতামত ব্যতিরেকে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির দরখাস্ত আহ্বানপূর্বক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে তিনি নতুন বিতর্কের জন্ম দেন এবং এর সপে লোকজনকে উৎসাহিত করতে সরকারি মন্ত্রীর মতো তিন পার্বত্য জেলায় সভা, সমাবেশ ও মিছিল করে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার গণবিজ্ঞপ্তি জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘খাদেমুল ইসলাম গত ২৮ – ২৯ ফেব্রুয়ারি একতরফাভাবে বিতর্কিত শুনানি কার্যক্রম শুরু করার চেষ্টা চালান। কিন্তু জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও বয়কটের মুখে তার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর একইভাবে ২ – ৩ মে দ্বিতীয় বার শুনানির চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি ‘বিশেষ ব্যবস্থায়‘ শুনানি শুরু করার কথা ঘোষণা দেন। সেই মোতাবেক তিনি ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে ২৩ – ২৪ মে এবং ১০ – ১১ জুন কোরাম ছাড়া শুনানি কার্যক্রম চালিয়ে যান। তিনি আগামী ২২ – ২৩ জুলাই পরবর্তী শুনানির তারিখও নির্ধারণ করেছেন।‘
ডিওয়াইএফ নেতা মনে করেন, ভূমি কমিশন আইনের অগণতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছ ধারাগুলো সংশোধনসহ কমিশন চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র মতা বাতিল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাগত ভূমি আইনের স্বীকৃতি ছাড়া চলমান তথাকথিত শুনানির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত ভূমি মালিকরা তাদের বেদখল হওয়া জমি ফিরে পাবেন না।
নতুন কুমার চাকমা আরো বলেন, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ভূমি কমিশনের একতরফা ও অবৈধ শুনানি বাতিল এবং প্রথাগত ভূমি অধিকারের দাবিতে ইতিমধ্যে সভা সমাবেশ, সড়ক-নৌপথ অবরোধ কর্মসূচী পালন করেছে। দাবি মানা না হলে আন্দোলনের কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।
গত ২৯ ও ৩০ মে টেকনাফের চাকমা পল্লীতে পুলিশ ও ভূমি দস্যুদের যৌথ হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর এবং নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘এ হামলায় তারা মোট ১১ জন গ্রামবাসীকে আহত, বেশ কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর ও ৭ গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করে। এছাড়া কমপে ৬ চাকমা নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন ও লাঞ্ছিত করা হয়। এর মধ্যে একজন অশীতিপর বৃদ্ধাও রয়েছেন। উ ছা থোয়াইং চাকমা নামে ৭ – ৮ মাসের গর্ভবতী এক মহিলাকে নির্যাতন করা হলে সঙ্গে সঙ্গে তার গর্ভপাত ঘটে এবং তার স্বামীকেও পুলিশ আটক করে। এ ছাড়া মালাইমে চাকমাকে কোমড়ে লাঠির আঘাত করা হলে তার প্রসব বেদনা শুরু হয় ও হাসপাতলে ভর্তি করার পর এক সন্তানের জন্ম হয়। এছাড়া ১৮ বছরের যুবতী লাকি চাকমার কোমড়ে ও পায়ে আঘাত করা হয়। গৃহিনী উষাখেইং চাকমা (বয়স ৪৫) গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের তদন্ত দলকে [৪-৫ জুন] জানান তাকে হামলাকারীরা লাথি মেরেছিল। এ সময় তার সামনে ৮৫ বছরের বৃদ্ধা শ্বাশুরীকেও নির্যাতন করা হয়। তিনি তার শ্বাশুরীকে না মেরে তাকে মারার জন্য কাকুতি মিনতি করলে তবেই তারা রেহাই দেয়। হামলাকারীরা রিম্রাচাং চাকমার (বয়স ৫৫) ১৫ বছরের কিশোরী মেয়ে মায়মাচিং সুমিকেও নির্যাতন করে। ডিওয়াইএফের তদন্ত টিম সুমির শরীরের স্পর্শকাতর অংশে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়।‘
হামলার সময় অর্থ লুটপাট, সম্পত্তি ধ্বংস ও বুদ্ধমূর্তি অবমাননা করা হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন এবং বলেন, এ হামলায় পুলিশ ৩ জন বাঙালিসহ ৭ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়।
হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চাকমাদের মালিকানাধীন জমি বেদখল করা মন্তব্য করে ডিওয়াইএফ নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘ভূমি দস্যু আব্দুল হক হোয়াই্যঙ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা জাফর আলম চৌধুরীর সহায়তায় বহু বছর ধরে শুকনা আমতলী গ্রামের চিংপুঅঙ চাকমাসহ সাত ভাইয়ের ১০ একর জমি বেদখল করার জন্য নানা পাঁয়তারা চালিয়ে আসছে। এ নিয়ে উভয় প পরস্পরের বিরুদ্ধে দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা দায়ের করেছে। গত ১২ মে আব্দুল হক ও তার দলবল জোটবদ্ধ হয়ে জোরপূর্বক উক্ত জমি দখলের চেষ্টা চালায়। তবে চাকমারা বাধা দিলে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ গত ২৯ মে রাতে সাদা পোষাকধারী দু‘জন পুলিশকে নিয়ে আব্দুল হকের লোকজন আমতলী গ্রামে যায়। তারা ভাক্তচিং চাকমা ও চিং ক্য হা চাকমাকে পথে পেয়ে মারধর করতে থাকে। তাদের আর্ত চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন ডাকাত এসেছে ভেবে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে। এ সময় শিপন মিয়া নামে এক পুলিশ সদস্য এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সে নিজেকে পুলিশ সদস্য পরিচয় দিলে লোকজন সরে যায়। এর কয়েক ঘন্টা পর ভোর রাতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ এসে চাকমা পল্লীর বাড়ি বাড়ি তল্লাশী ও হামলা চালায়।‘
গত ৪ মে ২০১২ উত্তরবঙ্গে নওগাঁ জেলার মান্দা থানাধীন চক গোপাল গ্রামে এক হামলায় সংখ্যালঘু সাঁওতাল জাতির ৪ ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘ঐদিন নিয়ামতপুর থানাধীন পুঙ্গী (নিভূদা) গ্রাম থেকে ৫ জন সাঁওতাল — চন্দ্রা কিস্কো (৪৩), ইলিয়াস মার্ডি (৪৪), মদন মাডি (৫১), মহারাম মার্ডি (৪১), ও কৃঞ্চ মার্ডি (৩১), — কামলা হিসেবে জনৈক ডালিমের ক্ষেতের ধান কাটতে যান। এ সময় ডালিমের বিপক্ষ আনোয়ার গংদের ৮০ – ৯০ জন লোক এসে তাদেরকে ধান কাটতে বাধা দেয়। সেখানে ডালিমের দলের ১৫ – ২০ জনও উপস্থিত ছিল। আনোয়ার গংদের লোকজন এক পর্যায়ে চারদিক থেকে ঘিরে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে সাঁওতালদের চন্দ্রা কিস্কো বেঁচে গেলেও বাকি ৪ জন আহত হয়ে ঘটনাস্থলের কিছু দূরে মারা যান।‘
তারা বলেন, ‘ উত্তরবঙ্গে সংখ্যালঘু জাতির জনগণের ওপর হামলা, নির্যাতন, লুটপাট ও ভূমি বেদখলের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে ভূমিদস্যু হাতেম আলী ও সীতেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য গদাই এর ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলায় আলফ্রেড সরেন নৃশংসভাবে খুন হন। ২০১০ সালের ১২ জুন নওগাঁ জেলার পোরশার খিতিরপুরে সংখ্যালঘু জাতির ৭২টি ঘর ও গত বছর ১২ জুলাই নিয়ামতপুরে ৪০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। রাজশাহীর তানোরে সংখ্যালঘু জাতির লোকজনকে হোটেল রেস্তোরাঁ এমনকি স্কুল কলেজের হোস্টেলেও ভাল থালায় খেতে দেয়া হয় না; তাদেরকে আলাদাভাবে রাখা কথিত ‘২ নম্বর প্লেটে‘ খাবার পরিবেশন করা হয়, যা এক সময় দক্ষিণ আফ্রিকায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও বৃটিশ আমলে এই উপমহাদেশে প্রচলিত বর্ণবাদ প্রথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।‘
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি নতুন কুমার চাকমা, সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিঠুন চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি অংগ্য মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি কণিকা দেওয়ান সহ আরো অনেকে।
নেতৃবৃন্দ সরকারের কাছে কিছু দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো ভূমি কমিশন সম্পর্কে: ক. চলতি বাজেট অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ এর সংশোধনী (অস্বচ্ছ ও অগণতান্ত্রিক ধারা সংশোধনপূর্বক) পাশ করতে হবে। খ. পার্বত্য ভূমি কমিশনের শুনানি বাতিলকরণ এবং ভূমি কমিশন আইনের ৩ (৫) ধারা মোতাবেক বিতর্কিত ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে অপসারণপূর্বক সকল পরে নিকট গ্রহণযোগ্য একজন নিরপেক্ষ, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। গ. জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুনর্বাসিত বহিরাগতদের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন ও রীতি উপো করে দেয়া অবৈধ ভূমি বন্দোবস্তি ভূমি কমিশন আইনের ৬ (গ) ধারা বাতিল করতে হবে এবং বহিরাগত সেটলারদেরকে সমতলে জীবিকার নিশ্চয়তাসহ পুনর্বাসন করতে হবে। ঘ. ভূমি কমিশনের সদস্য হিসেবে হেডম্যান ও কার্বারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং বিবাদিত/বিতর্কিত জমির মালিকানা সম্পর্কে তাদের লিখিত মতামত নেয়ার বিধান করতে হবে, কারণ এলাকায় ভূমির মালিকানা ও ব্যবহার সম্পর্কে তারাই হলেন সবচেয়ে সম্পৃক্ত ব্যক্তি। ঙ. পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাগত ভূমি আইনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও তার আলোকে ভূমি কমিশন আইনের সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে।
টেকনাফে চাকমা পল্লীতে হামলা সম্পর্কে: ১। টেকনাফের চাকমা পল্লীতে পুলিশ ও ভূমি দস্যুদের যৌথ হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তপূর্বক দোষী পুলিশ সদস্য, আব্দুল হক ও তার সহযোগীদের শাস্তি প্রদান; তিগ্রস্ত চাকমা ও বাঙালিদের ক্ষতিপূরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে দেয়া মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার নিশ্চয়তা দিতে হবে ও চাকমা সম্প্রদায়ের জানমাল রা করতে হবে। ২। এলাকার প্রভাবশালীরা যাতে চাকমাদের জমি অবৈধভাবে কেড়ে নিতে না পারে তার জন্য প্রশাসনের প থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।
নওগাঁয় ৪ সাঁওতাল হত্যা সম্পর্কে: ১। প্রকৃত হত্যাকারীদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে; নিহতদের পরিবারগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ২। সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ওপর হামলা, নির্যাতন ও ভূমি বেদখল বন্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের আশু কর্মসূচী
গত বছর ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করায় এদিনকে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম কাল দিবস ঘোষণা করেছে এবং উক্ত বিতর্কিত সংশোধনী বাতিলের দাবিতে আগামী ৩০ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজেলা সদরসমূহে বিক্ষোভ কমূসূচী পালন করবে। এছাড়া ঢাকায় সংগঠনের একটি প্রতিনিধিদল ভূমি কমিশনের শুনানি বাতিল, বিতর্কিত চেয়ারম্যানকে অপসারণ এবং বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন বাতিলের দাবিতে রাজনৈতিক দল-জোট, আইনজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে মতবিনিময় করবেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।