ইউপিডিএফের প্রতিবেদন: মাটিরাঙ্গা হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
সিএইচটিনিউজ.কম

এতে বলা হয়, গত ২৫ জানুয়ারী রাতে মাটিরাঙ্গা উপজেলার উক্ত দুই পাহাড়ি গ্রামে কমপক্ষে ২টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং ৩৪টি বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়। এছাড়া হামলাকারীরা হরিধন মগ পাড়ায় জিতাসুখা বৌদ্ধ বিহারের মাইকসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ও বিহারের বুদ্ধমূর্তি ভেঙে দেয়। এই হামলায় সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১৬,৮২,০০০ টাকা। তবে গ্রামের লোকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়ায় কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বিজিবি সদস্যরা বর্তমানে গ্রামের পাশে রাত-দিন অবস্থান করলেও গ্রামবাসীদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক কাটেনি।
ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর স্থানীয় নেতা ও এলাকার বিভিন্নজনের সাথে আলাপ করে জানা যায়, গত ২৫ জানুয়ারী ২০১৩ রাত আনুমানিক পৌনে আটটায় খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের বটতলী এলাকায় কতিপয় অজ্ঞাতনামা অস্ত্রধারী ‘ভাই ভাই‘ ব্রিক ফিল্ডের ম্যানেজার আবুল হোসেনকে অপহরণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইটভাটার শ্রমিকরা প্রতিরোধ করলে অস্ত্রধারীরা আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এতে ফারুক হোসেন (১৯) নামে এক শ্রমিক ঘটনাস্থলে নিহত এবং ম্যানেজার আবুল হোসেন ও শাহজাহান অপর এক শ্রমিক আহত হন।‘
পাহাড়ি গ্রামে হামলার ঘটনা উল্লেখ করেপ্রতিবেদনে বলা হয়, উক্ত ঘটনার পর সেটলার বাঙালিরা সংঘবদ্ধভাবে রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে লাঠিসোটা, দা ও কিরিচ নিয়ে পাহাড়ি-বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে মাটিরাঙ্গা সদর থেকে আনুমানিক ৪ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত পাহাড়িদের দুটি গ্রাম হরিধন মগ পাড়া ও হেমঙ্গ কার্বারী পাড়ায় হামলা চালায়। গ্রামবাসীরা ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। হামলাকারী সেটলাররা পাহাড়িদের শুন্য বাড়িঘরে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় এবং অন্ততঃ ২টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মাটিরাঙ্গা সদর ইউনিয়নের জনৈক প্রাক্তন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে বটতলী ও গাজী নগরের শতাধিক সেটলার এই হামলায় অংশ নেয়।
হামলার সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ভূমিকার ভূমিকার সমালোচনা করে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিট থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, হামলার সময় মাটিরাঙ্গা জোন ও ব্যাঙমারা ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা সেটলারদের পেছনে ছিল। তারা হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে কোন চেষ্টা করেনি। তবে হামলার পরদিন সকালে বিজিবি সদস্যরা অগ্নিসংযোগে ধ্বংস হওয়ার চিহ্ন মুছে দেয়ার জন্য পুড়ে যাওয়া দুইটি বাড়ি নতুন করে তৈরি করে দেয়। ঘটনার পর থেকে বিজিবি সদস্যরা তিগ্রস্ত উক্ত দুই গ্রাম ঘিরে রেখেছে।‘
হামলায় হরিধন মগ পাড়ায় চালাঅং মারমা (৩০) ও হেমঙ্গ কার্বারী পাড়ায় নীলমনি ত্রিপুরা (৫০) বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া হরিধন মগ পাড়ায় ২৯টি ও হেমঙ্গ কার্বারী পাড়ায় ৫টি বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর এবং হরিধন মগ পাড়ায় জিতাসুখা বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর করা হয়। হামলায় বৌদ্ধ বিহারের ক্ষতি বাদে পাহাড়িদের আনুমানিক ১৬,৮২,০০০ টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। হরিধন মগ পাড়ার কার্বারী বাদু কার্বারীর উদ্ধতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাঙালিরা আমাদের পাড়ায় একটি বৌদ্ধ বিহার ও বুদ্ধ মুর্তি ভাংচুর করে। তারা বুদ্ধ মূর্তিগুলোকে মাটিতে ফেলে দেয় এবং বিহারের মাইক ও অন্যান্য জিনিসপত্রও ভাংচুর করে।‘
হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি পরিবারকে নামমাত্র ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়। কিন্তু তা ক্ষতির তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। ইউপিডিএফ-এর স্থানীয় কমিটি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে। তবে পর্যাপ্ত ত্রাণের জন্য যে সরকারী উদ্যোগের প্রয়োজন তা এখনো অনুপস্থিত। আজ পর্যন্ত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোন কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেননি। খাগড়াছড়ির এমপি ২৬ জানুয়ারী মাটিরাঙ্গার বটতলী পর্যন্ত গেলেও, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামে যাননি।‘
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘ইটভাটায় সশস্ত্র হামলার খবর পত্র পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলেও পাহাড়ি গ্রামে সেটলারদের প্রতিশোধমূলক হামলার খবর আদৌ প্রচার পায়নি। স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদ মাধ্যমসমূহ এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করে। ইটভাটার শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রতিবাদে সেটলারদের সংগঠন বাঙালি ছাত্র পরিষদ ৩০ জানুয়ারী তিন পার্বত্য জেলায় হরতাল পালন করলেও, নিরীহ পাহাড়িদের গ্রামে হামলার প্রতিবাদে কেউ কর্মসূচী দেয়নি।‘
উভয় হামলার নিন্দা জানিয়ে ইউপিডিএফ এ ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি রোধে সরকারের কাছে তিনটি সুপারিশ পেশ করেছে। এগুলো হলো ১. মাটিরাঙ্গার বটতলীর ইটভাটায় বাঙালি শ্রমিকদের উপর সশস্ত্র হামলা ও পরবর্তীতে পাহাড়িদের গ্রামে বাঙালি সেটলারদের প্রতিশোধমূলক হামলার যথাযথ তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টাস্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ২. উক্ত দুই হামলায় তিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ৩. ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা যেমন সেটলারদের সমতলে পুনর্বাসন, পাহাড়ি ও বাঙালিদের সমন্বয়ে মিশ্র পুলিশ বাহিনী গঠন, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-এর খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক রিকো চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য জিকো ত্রিপুরা। এছাড়া পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের অন্যান্য নেতৃবৃন্দও এতে উপস্থিত ছিলেন।#