মুক্তমত

উন্নয়নের ঘুম পাড়ানি গান শুনে ঘুমিয়ে থাকলেই বিপদ

0

পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের একটি চিত্র। ছবি: লেখকের ব্লগে থেকে


নিরন চাকমা


১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক ‍”উন্নয়ন” নামক ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে আসছে। অনেকে এ গান শুনে মনের সুখে ঘুমিয়ে পড়েছেন, অনেকে ঝিমুচ্ছেন। তারা এই উন্নয়নের গানে এতই মোহিত হয়ে পড়েছেন যে, তাদেরকে কে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছেন না। ফলে ক্ষতি যা হবার তা হয়েই যাচ্ছে।

আমরা চুক্তির পর সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দিকে এক নজর দৃষ্টি দিলেই বুঝতে পারবো যে, কারা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে। যেখানে যেখানে সড়ক নির্মাণ হয়েছে সেখানে দেখবেন পাহাড়িরা জায়গা-জমি হারিয়ে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে, ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। এক্ষেত্রে দেখা যায়, সমতলে ক্ষতিগ্রস্তদের যে পরিমাণে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়, পাহাড়ে তার এক অংশ ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয় না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পাহাড়িরা কোন ক্ষতিপূরণই পায় না। কারণ পাহাড়িরা যেসব জায়গা ভোগদখল করে সেগুলোতে তাদের কোন কাগজপত্র থাকে না। তারা প্রথাগত পদ্ধতিতেই সমষ্ঠিগত মালিকানার ভিত্তিতে এসব জায়গা ভোগদখল করে থাকে। ফলে এসব জায়গা-জমি খাস ও সরকারেরর সম্পত্তি বলেই দায় এড়ানো হয়। এভাবে কথিত উন্নয়নের নামে এ যাবত কত হাজার একর ভূমি যে পাহাড়িদের হাতছাড়া হয়েছে তা সঠিক হিসাব জানা যায় না।

বন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যসহ মানুষের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে লংগদু-নান্যাচর সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাতিলের দাবি করছে স্থানীয় পাহাড়িরা। এ বিষয়ে তারা সমাবেশ ও সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে। কিন্তু উদ্বেগজনকভাবে লক্ষ্যণীয় যে, পাহাড়িদের এই আপত্তির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটলার বাঙালিদের। ফলে এতে পাহাড়ি ও সেটলার বাঙালিদের মধ্যে একটা বিবাদ সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবাইকে এ বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা উন্নয়ন চায় না সেটা নয়। কিন্তু যে উন্নয়ন একটি জাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়, নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হতে হয়, বন-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হয় সে ধরনের উন্নয়ন নিশ্চয় কেউই চাইবে না। পাহাড়িদের আপত্তিটা হচ্ছে সেখানেই। লংগদু-নান্যাচর সংযোগ সড়কটি নির্মিত হলে তা হয়তো মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের উপকার হবে, কিছু মানুষের পকেট ভারী হবে, কিন্তু এলাকার আপামর পাহাড়ি জনগণ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা জায়গা-জমি হারাবেন, উচ্ছেদ হবেন। শুধু তাই নয়, অবাধে পাহাড় কাটার ফলে ধ্বংস হবে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। আশঙ্কাটা মূলত এখানেই।

লংগদু-নান্যাচর সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি মূলত গ্রহণ করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। চব্বিশের গণঅভুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন পরবর্তী গঠিত ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশে শেখ হাসিনার আমলে গৃহিত অনেক প্রকল্প বাতিল করে দিচ্ছে। অনেক প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম ধরা পড়ছে। লংগদু-নান্যাচর সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটিও গ্রহণ করা হয়েছিল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের বিশেষত আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা-কর্মী ও তার সমর্থিত ঠিকাদার-ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী করার জন্য। কিন্তু অন্তর্বতী সরকার কোন কিছু যাচাই-বাছাই ও ক্ষতির দিক বিবেচনা না করেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। আর এতেই স্পষ্ট হয় যে, ফ্যাসিস্ট হোক কিংবা গণঅভুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার হোক পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে সবাই একই কাজ করে থাকে।

ইতোমধ্যে সীমান্ত সড়কের নামে অবাধে পাহাড়, বন-জঙ্গল কেটে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হযেছে। অনেক পাহাড়ি ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি হারিয়েছে, উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। কিন্তু সরকার পরিবেশ রক্ষার কথা বললেও এক্ষেত্রে তাদের কোন উচ্চবাচ্য নেই। তার মানে হচ্ছে পাহাড়ে যা ইচ্ছা তা-ই করা যাবে, বন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাতে সরকারের কিছু যায় আসে না।  

তাই, আমি বলবো, সরকারের উন্নয়নের ঘুম পাড়ানি গান শুনে আর ঘুমিয়ে থাকবেন না। পাহাড়িদের অস্তিত্ব নিয়ে যাতে কেউ ছিনিমিনি খেলা খেলতে না পারে সেজন্য সর্বদা জাগ্রত থাকুন, সজাগ থাকুন। ঘুমিয়ে থাকা মানেই বিপদ এটা সবসময় মাথায় রাখুন।

৩১.০৫.২০২৫

* লেখাটি নিরন চাকমার নিজস্ব ব্লগ থেকে নেওয়া হয়েছে।

[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More