কাউখালীতে বিদ্যালয়ে পরীক্ষার সময় রাঙামাটি ব্রিগেড কমান্ডারের শিক্ষা সামগ্রী ও কম্বল বিতরণ নিয়ে নানা প্রশ্ন

0
অনুষ্ঠানে কথা বলছেন রাঙামাটি ব্রিগেড কমান্ডার নাজমুল হক। ছবিটি ভিডিও থেকে নেওয়া।

কাউখালী প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫

রাঙামাটির কাউখালীতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালীন রাঙামাটি ব্রিগেড কমান্ডারের শিক্ষা সামগ্রী ও কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠান নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

গতকাল রবিবার (৭ ডিসেম্বর ২০২৫) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ব্রিগেড কমান্ডার নাজমুল হক ও রাঙামাটি সদর জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. একরামুল রাহাত উপস্থিত ছিলেন। তারা কয়েকজন সাংবাদিককেও সাথে নিয়ে আসেন। 

অভিযোগ উঠেছে, ‘ইউএনও কম্বল বিতরণ করবেন’ এমন কথা বলে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছিল।

জানা যায়, গত ৬ ডিসেম্বর দুপুরে ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন ইউপি সদস্য মন্টু রঞ্জন চাকমা ও অমর বিন্দু চাকমাকে ফোন করে বলেন যে, ‘আগামীকাল আমাদের কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্যার সেখানে আসবেন। তিনি কম্বল ও শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ করবেন।’

চেয়ারম্যানের কথা মত ইউপি সদস্য মন্টু রঞ্জন চাকমা ও অমর সিন্দু চাকমা চেলাছড়া সরকারি আবাসিক বিদ্যালয় মাঠে একটি মঞ্চ তৈরি করেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন (৭ ডিসেম্বর) সকালে তারা দেখেন ইউএনও নয়, এসেছেন রাঙামাটি ব্রিগেড কমান্ডার নাজমুল হক। এতে তারা দ্বিধায় পড়ে যান।

এ বিষয়ে ইউপি সদস্য মন্টু রঞ্জন চাকমা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অনুষ্ঠান নিয়ে আমাদের সাথে ধোঁকাবাজি করা হয়েছে। ইউএনও স্যার আসার কথা বলে ব্রিগেড কমান্ডার এসেছেন।’

আরেক ইউপি সদস্য অমর বিন্দু চাকমা বলেন, ‘আমরা বিগ্রেড কমান্ডার আসবেন তা জানি না। আমাদেরকে জানানো হয়েছে ইউএনও আসবেন বলে। কিন্তু ইউএনও না এসে ব্রিগেড কমান্ডার এসেছেন। তাদেরকে এভাবে ধোঁকা দেওয়া ঠিক হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ব্রিগেড কমান্ডারের “তোমাদের স্কুল নাই তাই না?” প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা “আছে” বলে উত্তর দিচ্ছে। ছবিটি ভিডিও থেকে নেওয়া।  

এদিকে, অনুষ্ঠানের এক ভিডিওতে দেখা যায়, ব্রিগেড কমান্ডার নাজমুল হক উপস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে “তোমাদের স্কুল নাই তাই না?”- এমন প্রশ্ন করলে শিক্ষার্থীরা “আছে” বলে উত্তর দেয়। অভিভাবকদেরও “পরীক্ষা আছে” এমন কথা বলতে শোনা যায়।

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের কয়েকজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের ছেলে-মেয়েদের বর্তমানে সরকারি নিয়ম অনুসারে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। কিন্তু পরীক্ষার সময় জোর করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গিয়ে শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা মোটেই উচিত হয়নি।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরো বলেন, ‘গত ৩ ডিসেম্বর থেকে চেলাছড়া খেলার মাঠ দখল করে সেনাবাহিনী অবস্থান করছে। সেখানে থেকে তারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সামরিক মহড়া এবং মাঠে উচ্চস্বরে কথা বলার জন্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সময় লেখা-পড়ার বিঘ্ন ঘটছে।’

কম্বল নিতে যাওয়া এক বৃদ্ধ বলেন, ‘সকালে আমাদের মেম্বার ইউএনও আসবেন এবং কম্বল বিতরণ করবেন বলে জানালে আমি কম্বল নিতে যাই। কিন্তু গিয়ে দেখি সেনাবাহিনী কম্বল বিতরণ করছে। তারা কম্বল দেবে সেটা আগে জানতাম তাহলে আমি সেখানে যেতাম না। কারণ সেনাবাহিনী ‘শান্তির’ নামে আমাদের পাড়া-গ্রামে এসে নিপীড়ন-হয়রানি করে, ভয়ভীতি দেখায়। আমাদের সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়।’

এলাকার এক কার্বারী বলেন, ‘সেনাবাহিনীর সদস্যরা গত ৩ ডিসেম্বর এসে আমাদের পাড়ার খেলার মাঠ দখল করে অবস্থান করেছে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সামরিক মহড়া বা টহল দিয়ে জনগণের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছে।’

নাম প্রকাশ্য অনিচ্ছুক চেলাছড়া গ্রামের এক নারী বলেন, ‘সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে আসার কারণে আমরা রাতে বাড়ি থেকে বের হতে পারি না। কোথাও যেতে চাইলে সেনারা ‘কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন’ বলে নানা প্রশ্ন করে। সেনারা অবস্থানের কারণে আমাদের নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। আমরা বিশেষত নারীরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছি।’

একদল সেনা সদস্য তাদের বাড়িতে গিয়ে ‘কম্বল ও চিকিৎসা সেবা’ নিতে চেলাছড়া সরকারি আবাসিক বিদ্যালয় মাঠে যেতে বলেছেন বলেও ওই নারী জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুষ্ঠানে খুবই অল্প সংখ্যক লোকজন উপস্থিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া চেলাছড়া সরকারি আবাসিক বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীকেও সেখানে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। 

কিন্তু ব্রিগেড কমান্ডার নাজমূল হক সাংবাদিকের সামনে কথা বলার সময় অনুষ্ঠানে লোকজনের উপস্থিত কম হওয়ার জন্য বরাবরের মতোই ইউপিডিএফকে দোষারোপ করেছেন।

তবে ইউপিডিএফের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বলেছেন, সেনাবাহিনীর নানা অন্যায়-অত্যাচার ও হয়রানির কারণে মানুষ অতিষ্ঠ। যার কারণে লোকজন তাদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন না। সেনাবাহিনী তাদের অপকর্ম ঢাকতেই সবখানে ইউপিডিএফের গন্ধ পায়, যা তাদের চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

উল্লেখ, গত ৩ ডিসেম্বর থেকে চেলাছড়া খেলার মাঠ দখল করে শতাধিক সেনা সদস্য অবস্থান করছে। তারা আগামী ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে থাকবে বলে জানা গেছে। সেখান থেকে সেনারা প্রতিদিন গাড়ি যোগে এবং হেঁটে চেলাছড়া, বাদলছড়ি, যৌথ বাগান, লেভা পাড়া, হারাঙ্গি রিফিউজি পাড়া, কজইছড়ি গ্রামে টহল দেয়। এর ফলে এলাকার জনগণ আতঙ্ক ও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায়ও ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে, গত ৩১ অক্টোবর থেকে মিটিঙাছড়ি, রাজখালি, রৈস্যাবিল, সাদেক্যাবিল, চৌচলাবিল, ধুল্লেছড়ি, মঘাছড়ি, বেতছড়ি এলাকায় সন্তু লারমার জেএসএস পরিচালিত একটি সশস্ত্র দল অবস্থান, বিচরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করলেও এবং এলাকাবাসী তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানালেও সেসব এলাকায় সেনাবাহিনীর কোন টহল বা অপারেশন নেই। ফলে সন্ত্রাসী দলটি এখনো ওইসব এলাকায় বহাল তবিয়তে থেকে অবাধে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More