খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে ৪ পাহাড়ি হত্যার বিচারের লক্ষ্যে দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি ৪৪ নাগরিকের

0

ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪

দেশের ৪৪ জন নাগরিক ও অধিকার কর্মী গত ১৮ সেপ্টেম্বর, পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে ৩ জন এবং ও রাঙামাটিতে আরো ১ জন মোট ৪ জন পাহাড়ি আদিবাসী হত্যা, তাদের বাড়ীঘরে আগুন, লুট ইত্যাদির নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও উচ্চ পর্যায়ের তদন্তও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে এক যৌথ বিবৃতি প্রদান করেছেন। 

আজ বুধবার (২ অক্টোবর, ২০২৪) প্রদত্ত বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা জানি, গত ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খাগড়াছড়ি সদরের পানখাইয়া পাড়ায় এবং মোহাম্মদ মামুন (৩০) নামের এক  যুবক মটর সাইকেল চুরি করার অভিযোগে গণপিটুনির শিকার হন এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। নিহত মামুনের  স্ত্রী থানায় যে মামলা করেছেন তাতেই সুস্পষ্টভাবে হত্যার জন্য দায়ী তিনজন সেটেলার বাঙালীর নাম উল্লেখ করে আরো  অজ্ঞাতনামা অনেকের বিরুদ্ধে এই হত্যার অভিযোগ করেছেন। 

তার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্রকরে পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সেটলার বাঙালী এবং স্থানীয় পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর  মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষকে উপলক্ষ করে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় আদিবাসীদের ৩৭টি ঘরবাড়ি ও  দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অভিযোগ— নিরাপত্তার দায়িত্বে  যারা ছিলেন তাদের কেউ কেউ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার বদলে আদিবাসীদের উপর হামলায় লিপ্ত ব্যক্তিদের নানাভাবে  উৎসাহ ও মদদ যুগিয়েছে। গুলিতে জুনান চাকমা (২০), ধন রঞ্জন চাকমা (৫০) এবং রুবেল ত্রিপুরা (২০) নিহত হয়। 

খাগড়াছড়ির ঘটনার জের ধরে গত ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাঙামাটিতে আদিবাসী ও সেটলার বাঙালীদের মধ্যে দফায়  দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ডিসি অফিসের ২০০ গজের মধ্যে একটি চায়ের দোকানে বসে থাকা অনিক চাকমা  (১৭)কে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ভিডিও ফুটেজে হত্যাকারীদের স্পষ্ট চেহারা এবং পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলেও এখন  পর্যন্ত তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। ঘটনার সময় ভাংচুর চালানো হয়েছে বনরূপা মৈত্রী বিহারে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে  পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিস। এ সব ঘটনায় কাউকে অভিযুক্ত বা গ্রেফতার এখনো করা হয়নি। 

বিবৃতিতে নাগরিকগণ আরো বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্তবর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা ঘটনাক্রান্ত ২ জেলা খাগড়াছড়ি  ও রাঙামাটি সফর করেন। তারা রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে সেনানিবাসে বসে কথিত বাঙালী এবং জাতিগত নেতৃবৃন্দের  সাথে মতবিনিময় করেন। কিন্তু নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কোন সদস্যের সাথে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গিয়ে  ভুক্তভোগীদের মতামত শোনেননি বা তাদের কোন সান্ত্বনা দেননি। আদিবাসী নাগরিক সমাজের কতিপয় ব্যক্তি একটি  মতবিনিময় সভায় ছিলেন বলে জেনেছি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ যেমনভাবে হতাশ ও মর্মাহত হয়েছিল,  আমরাও দারুনভাবে বিস্মিত। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবশ্য কঠোর ভাষায় বলেছেন, এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কাউকে  ছাড় দেয়া হবেনা। কিন্তু ভিডিও ফুটেজে হত্যাকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের অনেককে স্পষ্ট শনাক্ত করা গেছে, তাদের কাউকে  এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশের কোন তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। 

এখানে এও উল্লেখ্য খাগড়াছড়ির হত্যাকান্ডের পরের দিনই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ঐ জেলা সফর করেছেন। তার আগে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ খাগড়াছড়িতে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষের সাথে মতবিনিময়কালে কিছু অপাহাড়ি তাতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে এবং হট্টগোল করেছিল বলে সংবাদ মাধ্যমের খবর থেকে আমরা জেনেছি। 

বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সাথে লক্ষ করছি দশকের পর দশক পার্বত্য তিন জেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ সারা  দেশের আদিবাসীরা অন্যান্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে এবং স্বাধিনতা  পরবর্তী দশকের পর দশক ধরে যে বৈষম্যর শিকার হয়ে আসছে, মৌলিক নিরাপত্তা ও মানবিক আচরণের ক্ষেত্রেও একই ধরণের রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও অবহেলার মধ্যে দিনাতিপাত করেন। ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রেও বার বার তাদের বঞ্চিত করা

হচ্ছে। এটা বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র—জনতার অভুত্থানের মধ্য  দিয়ে অর্জিত সাফল্যের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

নাগরিকগণ প্রশ্ন রেখে বিবৃতিতে বলেন, আমাদের সুস্পষ্ট জিজ্ঞাসা খাগড়াছড়িতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর সভায় যারা গোলমাল করেছিল আর যারা পাহাড়ে হত্যাকান্ড, লুটপাট, অগ্নি সন্ত্রাস চালায় তারা কি একই গোষ্ঠী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই নিরপেক্ষ তদন্ত এবং অবিলম্বে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে যে হত্যাকান্ড ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর ঘটেছে, তার সঙ্গে লুট, সরকারি ও বেসরকারি সম্পদ ধ্বংস এ সবের উচ্চ পর্যায়ের স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি সরকারের কাছে ৫ দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলো:

১) খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ৪ জন আদিবাসী হত্যাসহ সকল ঘটনার সুষ্ঠূ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত  করতে হবে। ভিডিও ফুটেজে চিহ্নিত দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। 

২) নিহত ৪ পাহাড়ি আদিবাসী পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যে সকল বাড়ীঘর  লুটপাট করা হয়েছে এবং দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাদেরকেও যথাপোযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। 

৩) পাহাড়ে শান্তি ও সমঝোতার পরিবেশ বজায় রাখতে অপ্রকাশ্যে পাহাড়ি বিরোধী কোন বহিরাগত জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় কোন এজেন্সি বা মহল থেকে মদদ বা সহায়তা দেয়া অবিলম্বেবন্ধ করতে হবে।

৪) সকল অংশীজনদের সাথে আলোচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে একটি সময়নির্দিষ্ট (Time bound) রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, যেটি বৈষম্যমুক্ত ’নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্ন বাস্তবায়নে অপরিহার্য।

৫) সাম্প্রতিক হত্যাকান্ড, লুট, অগ্নি সংযোগ এবং অন্যান্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে  অবিলম্বে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সকল অংশীজন এবং দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের উচ্চ প্রতিনিধিদের নিয়ে গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করতে হবে। সেই আলোচনার সুপারিশের ভিত্তিতে স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবস্থা  গ্রহণ করতে হবে। 

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন- সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; খুশি কবীর, সমন্বয়ক, নিজেরা করি; অ্যাড. জেড আই খান পান্না, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি; পারভীন হাসান, উপাচার্য, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি; অ্যাড. সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম; ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অনারারি নির্বাহী পরিচালক, ব্লাস্ট; অ্যাড. তবারক হোসেন, সিনিয়র আইনজীবী; শিরিন পারভীন হক, সদস্য, নারী পক্ষ; সামিনা লুৎফা, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ড. শহিদুল আলম, আলোকচিত্রী; ড. সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; তাসলিমা ইসলাম শমি, ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী, বেলা; রেহনুমা আহমেদ, লেখক; ড. শাহনাজ হুদা, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ফেরদৌস আজিম, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়; রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়; ড. খাইরুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; জোবায়দা নাসরিন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়; শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি; এড. সালমা আলী, নির্বাহী পরিচালক, বি এন ডব্লিউ এল এ; গীতি আরা নাসরিন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়; সাদাফ নুর, সিনিয়র রিসার্সার, লেনচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়; মির্জা তাসলিম সুলতানা, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাড. মিনহাজুল হক চৌধুরী, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; রোজিনা বেগম, গবেষক ও অধিকার কর্মী; মাইদুল ইসলাম,সহযোগি অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; ড. স্বপন আদনান, ভিটিং প্রফেসর লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স এন্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স; ড. ফস্টিনা পেরেইরা, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; নোভা আহমেদ, অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়; ফারহা তানজীম তিতিল, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়; তাসনীম সিরাজ মাহবুব, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ; অ্যাড. সাইদুর রহমান, প্রধান নির্বাহী, এমএসএফ; ব্যারিস্টার আশরাফ আলী, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; ব্যারিস্টার শাহদাত আলম, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; অ্যাড. নাজমুল হুদা, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; অ্যাড. মো: আজিজুল্লাহ ইমন, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; হানা শামস আহমেদ, আদিবাসী অধিকার কর্মী; মুক্তাশ্রী চাকমা, কোর গ্রুপ, সাঙ্গাত প্রমুখ।

এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা স্বাক্ষরে বিবৃতিটি সংবাধ মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More