খাগড়াছড়িতে শহীদ জুনান-রুবেল-ধনরঞ্জন-অনিকের স্মরণে বার্ষিক স্মরণসভা
ঘটনাস্থলকে “শহীদ জুনান-রুবেল স্কয়ার” ঘোষণা

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
২০২৪ সালের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর সেনা-সেটলার কর্তৃক ‘নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও তান্ডবলীলার ১ বছর’ উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে শহীদ জুনান-রুবেল-ধনরঞ্জন ও অনিকের স্মরণে বার্ষিক স্মরণসভা করেছে শহীদ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গ।
স্মরণসভায় শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল টিউফা আইডিয়াল স্কুল গেটের সম্মুখ স্থানকে ‘শহীদ জুনান-রুবেল স্কয়ার’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

আজ শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সকাল ১০টায় শহীদ জুনান চাকমার গ্রামে সমবেত হয়ে মিছিল সহকারে ঘটনাস্থল টিউফা আইডিয়াল স্কুল গেইটের সামনে এসে অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্মরণসভার ব্যানার শ্লোগান ছিল “পাহাড়-সমতলে ফ্যাসিস্ট প্রেতাত্মাদের উৎপাত রুখে দিতে গণতান্ত্রিক শক্তি একাত্ম হোন।


অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে জুনান চাকমার মা রূপসা চাকমা, রুবেল ত্রিপুরার মা নিরন্তা দেবী ত্রিপুরা, পিসিপি-এইচডব্লিউএফ’র পক্ষ থেকে মিঠুন চাকমা ও নীতি চাকমা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া এলাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকেও অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।


এরপর অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় প্রাঞ্জল চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন শহীদ রুবেল ত্রিপুরার মা নিরন্তা দেবী ত্রিপুরা, শহীদ জুনান চাকমার মা রূপসা চাকমা এবং সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা।
শহীদ রুবেল ত্রিপুরার মা নিরন্তা দেবী ত্রিপুরা বলেন, গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী রুবেল ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যা করেছে। রুবেল ত্রিপুরা কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। ঘটনার ১ বছর হয়েছে, কিন্তু এখনো সুষ্ঠু বিচার পাইনি। খুনিদের বিচার করা না হলে আমার মতো আরো অনেক মায়ের বুক খালি হবে। তাই আর কোন মায়ের বুক যাতে খালি না হয় সেজন্য আমার ছেলের খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানাই।

শহীদ জুনান চাকমার মা রূপসা চাকমা বলেন, সেদিন আমার ছেলে জুনান চাকমা ‘মা আমি একটু বাইরে ঘুরে আছি, আধা ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবো’ বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর জীবিত ফিরতে পারেনি। সে কোন রাজনীতি করতো না, সাধারণ একজন ছাত্র ছিল। পাড়া প্রতিবেশী-শিক্ষকরাও তাকে অনেক ভালো বলতো।
কী দোষ করেছিল আমার ছেলে? কেন তাকে সেনাবাহিনী গুলি করে ও বন্দুকের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলেছে?
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার পর অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আমার বাড়িতে গিয়ে ছেলে হত্যার বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ এক বছর হয়ে গেল, কিন্তু কোন বিচার পাইনি।

তিনি আরো বলেন, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী চাই না। কারণ তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে মূল ষড়যন্ত্রকারী, হত্যাকারী ও নিপীড়ক। আমরা চাই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হোক।
তিনি জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা, ধনরঞ্জন চাকমা ও অনিক চাকমা হত্যার সাথে জড়িত সেনা সদস্য ও সেটলারদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানান।
স্মরণসভা থেকে তিনি সেনাবাহিনী কর্তৃক গুলি করে জুনান ও রুবেলকে হত্যার ঘটনাস্থল টিউফা আইডিয়াল স্কুল গেইটের সম্মুখ স্থানকে “শহীদ জুনান-রুবেল স্কয়ার” হিসেবে ঘোষণা করেন।
সংহতি বক্তব্যে হিল উইমেন্স ফেডাারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা বলেন, আমরা দেখেছি সেনাবাহিনী কীভাবে গুলি করে জুনান ও রুবেলকে হত্যা করেছে। ঘটনার আজ এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার কোন বিচার করেনি। উপরন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীকে দিয়ে নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ফিলিস্তিনিদের মতো জীবন-যাপন করতে হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত নিপীড়ন-নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যার শিকার হতে হচ্ছে পাহাড়িদের। বাংলাদেশের মানুষ ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনে হা-হুতাশ করে বটে, পার্বত্য চট্টগ্রামে দমন-পীড়ন দেখে না।
তিনি বম জাতিসত্তার ওপর সেনাবাহিনীর অন্যায় নিপীড়ন ও সম্প্রতি মানিকছড়ি-গুইমারা সীমান্তের তবলাপাড়া-কালাপানিতে সেনাবাহিনী সশস্ত্র সন্ত্রাসী পাঠিয়ে এলাকায় অরাজকতা সৃষ্টি ও জনগণের ওপর হামলা-গুলিবর্ষণের ঘটনা তুলে ধরেন।
নীতি চাকমা অবিলম্বে জুনান-রুবেল-ধন রঞ্জন-অনিক হত্যায় জড়িত সেনা সদস্য ও সেটলারদের গ্রেফতার ও বিচার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাশাসন তুলে নেয়ার দাবি জানান।
উল্লেখ্য, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেড় মাস না পেরোতেই ২০২৪ সালের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সেনা-সেটলার কর্তৃক বর্বরোচিত হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে সেনাবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনে দীঘিনালায় ধন রঞ্জন চাকমা, খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলিতে জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরা এবং রাঙামাটিতে সেটলারদের হামলায় অনিক চাকমা নিহত হন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।