খাগড়াছড়িতে ৫ নারী সংগঠনের জনপ্রতিনিধি ও পেশাজীবী সমাবেশ
খাগড়াছড়ি: আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে আজ ১ মে (সোমবার) বিকালে খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজারে ইউপিডিএফ কার্যালয়ের সামনে জনপ্রতিনিধি ও পেশাজীবি সমাবেশের আয়োজন করেছে ৫ নারী সংগঠন(হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ, সাজেক নারী সমাজ, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি, আত্মরক্ষা নারী কমিটি)। সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন, নিপীড়িন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগ্রামের পাশাপাশি বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে পেশাজীবী-ব্যবসায়ী-কৃষক-শ্রমিকসহ সকল শ্রেনিপেশার জনগণকে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান।
এছাড়া ৫ নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র ঋনের নামে অমানবিক শোষণ বন্ধ, উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ ও মিল ফ্যাক্টরিতে নারীর নিরাপত্তা, নারী জনপ্রতিনিধিদের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত করা, বিচার সালিশে নারীদের অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন দাবিনামা পেশ করা হয়।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিরুপা চাকমা। বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমা, কার্বারী এসোসিয়েশনের সভাপতি ও খাগড়াছড়ি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রনিক ত্রিপুরা, পানছড়ি উপজেলার উল্টাছড়ি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বিজয়কেতন চাকমা, চেংগী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কালাচাঁদ চাকমা, লক্ষীছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রবিল কুমার চাকমা, বিশিষ্ট সমাজসেবী সুমিত্রা চাকমা, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউপির নারী কার্বারী মুক্তসোনা চাকমা, দিঘীনালা বাবুছড়া ইউনিয়নের মেম্বার প্রতিভা চাকমা। এছাড়া সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন মেম্বার কুসুমতারা চাকমা, মহালছড়ি ৭ নং ওয়ার্ড মেম্বার তান্টুমনি চাকমা, দুরপুজ্জে নালা গ্রামের কার্বারী কুনেন্টু খীসা, লক্ষীছড়ি হেডম্যান চাইথোয়াই মারমা প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন নারী আত্মরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক এন্টি চাকমা।
সমাবেশে ইউপিডিএফএর সংগঠক মিঠুন চাকমা বলেন, আজ আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নিপীড়ন নির্যাতন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হচ্ছে, ভুমি বেদখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে হচ্ছে, খুন ধর্ষণ জেল জুুলুম হুলিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তবে এই অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের পেশাজীবি সমাজকে বিভিন্ন পেশা সংশ্লিষ্ট দাবিদাওয়া ভিত্তিক আন্দোলন সংগ্রামও গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পেশাজীবি সমাজকে নানা চাপের মধ্যে থাকতে হয়। যারা ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, দোকানদার বা বিভিন্ন ধরণের আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে জড়িত তারা নানাভাবে বৈষম্য নিপীড়িনের শিকার হয়ে থাকেন। তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরণের সাম্প্রদায়িক হয়রানী বৈষম্য চালু রাখা হয়। এভাবে সকলক্ষেত্রে পাহাড়ি ব্যবসায়ী পেশাজীবি সমাজ আজ বৈষম্যের শিকার। তিনি এই বৈষম্য নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক হয়রানীর বিরুদ্ধে পেশাজীবি সমাজকে সংগঠিত হবার আহ্বান জানান। তিনি জনপ্রতিনিধিগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা জনপ্রতিনিধি তাদের নানা রক্তচক্ষু হয়রানী সহ্য করতে হয়। তবে সত্যিকারভাবে পার্বত্য জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে এই রক্তচক্ষু ও হয়রানী বা জেলজুলুম হুলিয়ায় ভীত ও বিভ্রান্ত না হয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনে শরিক হতে হবে। এবং প্রকৃতপক্ষে এভাবেই পার্বত্য নিপীড়িত জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা যাবে।
হিল উইমেন্স ফেডারশেন কেন্দ্রীয় সভাপতি নিরূপা চাকমা বলেন, ঘরে বাইরে পাহাড়ি নারীদের নিরাপত্তা আজ নেই। সেনাবাহিনী রমেল চাকমাকে নির্যাতন করে হত্যা এবং তার লাশ ছিনিয়ে নিয়ে পোড়ানোর পরে দেশেবিদেশে প্রতিবাদ সংগ্রাম জোরদার হয়েছে। এরইমধ্যে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পানছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি জুয়েল চাকমাকে গতকাল রবিবার ভোররাতে বাড়ি থেকে আটক করা হয়েছে। তাকে অমানুষিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। লক্ষীছড়ি ও পানছড়িতে আয়োজিত গতকালের প্রতিবাদ মিছিলে সেনাবাহিনী হামলা চালিয়েছে। এতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী দ্বিতীয়া চাকমা ও রেশমি মারমাসহ অনেকে আহত হয়েছে। তিনি এই ধরণের নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীসমাজকে সোচ্চার হতে আহ্বান জানান।
এছাড়া তিনি নারী নেত্রীদের উপর প্রদত্ত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আগামী ১ জুন আধঘন্টাব্যাপী প্রতীকী সড়ক অবরোধ ঘোষনা প্রদান করেন।
কার্বারী এসোসিয়েশনের সভাপতি ও ভাইস চেয়ারম্যান রনিক ত্রিপুরা পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অধিকার প্রদানের উপর জোর প্রদান করেন। এছাড়া তিনি পেশাজীবি সমাজকে নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান।
দঘিন হবংপুজ্জে গ্রামের সমাজসেবিকা সুমিত্রা চাকমা বলেন, খাগড়াছড়িতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ মানবন্ধন করলেও বাধা দেয়া হয়। দঘিন হবংপুজ্জে এলাকায় একবার এক যুবককে পুলিশ অন্যায়ভাবে আটক করার চেষ্টা চালায়। পরে গ্রামের নারী ও পুরুষ সকলে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করার কারণে পুলিশ যুবককে আটক করতে পারেনি। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন গ্রামের নারী-পুরুষসহ সকলকে প্রতিবাদে শরিক হতে হবে।
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি গ্রামের কার্বারী মুক্তসোনা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে মিথ্যা মামলা দিয়ে ভোগান্তি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
দিঘীনালা উপজেলার বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার প্রতিভা চাকমা বলেন, একসময় ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ব্রাক-গ্রামীণ ব্যাংক এলাকায় এলাকায় শোষণের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তখন আমাদের মা-বোনদের খেয়ে না খেয়ে এমনকি চুরি করে হলেও ঋণ শোধ করতে হয়েছিল। তিনি ইউপিডিএফকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ইউপিডিএফ এই সমস্যা সমাধান করতে ভুমিকা রেখেছিল। তাই এখন নারীরা অনেক হয়রানী থেকে মুক্তি পেয়েছে।
তিনি ইতি চাকমা ও রমেল চাকমাকে হত্যা নির্যাতনের কথা তুলে ধরে বলেন, এই খুন হত্যার প্রতিবাদে আমাদের রাজপথে থাকা দরকার। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে একসময় আপনার আমার বা আমাদের মা-বো-ভাই-পুত্র-কন্যারাও যে এই ধরণের অবস্থার শিকার হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা তো নেই।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদে প্রদত্ত উন্নয়ন বরাদ্দের এক তৃতীয়াংশ নারী জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সত্যিকারভাবে বাস্তবায়নের দাবি জানান। তিনি পুরুষ কার্বারীর পাশাপাশি নারী কার্বারীদের যথাযথ মর্যাদা দেয়ার দাবি জানান।
সমাবেশে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে পুরুষ ও মহিলা কার্বারী এবং হেডম্যানগণ, নির্বাচিত মেম্বার ও চেয়ারম্যানগণ উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে প্রায় দুই শতাধিক নারী ও পুরুষ অংশগ্রহন করে।
——————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।