চব্বিশের ১৯-২০ সেপ্টেম্বরের হামলা-হত্যাকাণ্ড: বিচারহীনতার এক বছর

0


ডেস্ক রিপোর্ট, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত হয় নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর দেড় মাস না পেরোতেই ২০২৪ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদরের নারাঙহিয়া-স্বনির্ভর এবং রাঙামাটি জেলা শহরে পাহাড়িদের ওপর সেনা-সেটলারদের ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। এ হামলায় দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর মধ্যযুগীয় নির্যাতনে মারা যান ধন রঞ্জন চাকমা, খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর এলাকায় সেনাদের নির্বিচার গুলিতে নিহত হন কলেজ ছাত্র জুনান চাকমা ও রাজমিস্ত্রী রুবেল ত্রিপুরা এবং রাঙামাটিতে সেটলাররা পিটিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে কলেজ ছাত্র অনিক চাকমাকে। এছাড়া উক্ত তিন স্থানে হামলায় অন্তত ১৩৮ জন পাহাড়ি আহত হন, যার মধ্যে রয়েছেন খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর গুলিতে গুরুতর আহত ২১ জন।

বর্বরোচিত এই হামলায় দীঘিনালায় ১৯০টি দোকান ও রাঙামাটিতে ছোট-বড় অন্তত ১০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে যায় অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলাকারী সেটলার বাঙালিরা রাঙামাটিতে পার্বত্য চটগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিসেও হামলা চালায় এবং সেখানে গ্যারেজে রাখা ৯টি গাড়ি ও একটি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া ১৮টি বসতবাড়ি, ৮৫টি ভাসমান দোকানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, ৪৬টি যানবাহন, ৮টি ব্যাংক, দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ২টি বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর হয়।

ঘটনার পর ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়), লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (স্বরাষ্ট্র) ও সুপ্রদীপ চাকমা (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক) রাঙামাটি সফর করেন। তারা একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। অন্যদিকে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দীঘিনালায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় জনগণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে মত বিনিময় করে ঘটনার বিচারের আশ্বাস প্রদান করেন।

এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সরকার হামলার ঘটনা তদন্তের জন্য চট্টগ্রাম ডিভিশনের অতিরিক্ত কমিশনার (উন্নয়ন) মোহম্মাদ নুরুল্লা নুরীকে প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার তিন অতিরিক্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও তিন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তবে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) জাতিসংঘের মাধ্যমে ঘটনার তদন্তের দাবি জানায়। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন, আইডব্লিউজিআইএ-সহ অনেক সংগঠন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ও অংশগ্রহণে তদন্তের দাবি করে।

কিন্তু এক বছরেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্বরোচিত এ হামলার বিচার তো দূরের কথা, তদন্ত রিপোর্ট পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে শালবন শাপলা মোড়ের বাসিন্দা ও “মা ফার্নিচারের” মালিক মো. মামুন নামে এক বাঙালি সেটলার খুন হন। এই ঘটনার পরদিন তার স্ত্রী মুক্তা আক্তার তিন জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জন পাহাড়ি ও বাঙালিকে আসামী করে খাগড়াছড়ি থানায় মামলা দায়ের করেন।

প্রথমদিকে খাগড়াছড়ি মডেল থানার ওসি আব্দুল বাতেন মৃধা জানিয়েছিলেন, একটি মোটর সাইকেল চুরি করে পালানোর সময় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা খেয়ে মামুন আহত ও পরে হাসপাতালে মারা যান। কিন্তু এনটিভির একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, মামলায় অভিযুক্ত শালবনের বাসিন্দা মো. শাকিলসহ কয়েকজন বাঙালি সেটলার মামুন ও তার দোকানের কর্মচারী শাহীনকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে সেনা-সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। শাকিল ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সোর্স ও চাঁদাবাজির অংশীদার বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

মামুনের মৃত্যুর পর ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলের দিকে খাগড়াছড়ি শহরের মধুপুরে বাঙালি সেটলাররা সংঘবদ্ধভাবে পাহাড়িদের বাড়িঘরে হামলার চেষ্টা চালায়। তবে পাহাড়িরা প্রতিরোধ করলে সেটলারদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

দীঘিানলায় সেটলারদের মিছিল থেকে পাহাড়িদের ওপর হামলা
মামুনকে পাহাড়িরা হত্যা করেছে অভিযোগ তুলে ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টার দিকে বাঙালি ছাত্র পরিষদ দীঘিনালায় একটি মিছিল বের করে। ৩০-৪০ জনের মতো বাঙালি ছাত্র এতে অংশ নেয়। তারা “পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কালো হাত ভেঙে দাও, পাহাড়িদের ধরে ধরে জবাই কর, আমার ভাই মরলো কেন প্রশাসনের জবাব চাই’ ইত্যাদি পাহাড়ি বিদ্বেষী উগ্র সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিতে থাকে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মিছিলকারী সেটলাররা প্রথমে উন্নয়ন বোর্ড ও ব্র্যাক ব্যাংকের সামনে থাকা ৮-১০টি দোকানে হামলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু লোকজন প্রতিরোধ করলে তারা পিছিয়ে যায়। এরপর তারা স্টেশনের দিকে যায় এবং এক মারমার দোকানে ঢিল ছুঁড়ে মারে। এতে নিপুন চাকমা নামে এক চাল ব্যবসায়ী জখম হন। তবে সেখানেও হামলাকারীদের প্রতিরোধ করা হলে তারা পালিয়ে যায়।

এরপর নিকটস্থ মসজিদ থেকে “পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা মারছে, গুলি করছে” বলে মাইকে ঘোষণা করা হয় এবং পাহাড়িদের ওপর হামলা করতে বাঙালিদের উস্কানি দেয়া হয়। এই ঘোষণার সাথে সাথে বোয়ালখালি, জামতলি ও গরু বাজারের দিক থেকে শত শত সেটলার বাঙালি ধেয়ে আসে এবং পাহাড়িদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। তখন আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৪টা। হামলাকারীদের ঠেকাতে সেনা-মদদপুষ্ট ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সদস্যরা তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ফাঁকা গুলি করে। কিন্তু তাতে হামলাকারী সেটলাররা নিবৃত্ত হয়নি। এ সময় সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে সেটলারদের পক্ষ নেয়, এবং ফাঁকা গুলি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে পাহাড়িদের তাড়িয়ে দেয়। এরপর সেটলাররা বটতলা ও লারমা স্কোয়ারে পাহাড়িদের দোকানে ব্যাপক লুটপাট চালায় ও আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের আক্রমণে ডাব বিক্রেতা লেনিন চাকমা গুরুতর আহত হন। তিনি বোয়ালখালি ইউনিয়নের কামুক্কছড়া তুলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা, তার পিতার নাম বুদ্ধজয় চাকমা।

সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে দীঘিনালায় দোকানপাটে আগুন লাগিয়ে দেয় সেটলাররা। ফাইল ছবি

পাহাড়িদের অনেকে পালিয়ে লারমা স্কোয়ারে তপোবন বৌদ্ধ বিহারে আশ্রয় নিলে সেখানেও বাঙালিরা হামলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু পাহাড়িরা প্রতিরোধ করলে তারা পালিয়ে যায়। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে চাইলে বাঙালিরা আটকিয়ে দেয়।

এ হামলায় মোট ১০ জন আহত হন ও ১৯০ টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যার ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৩ কোটি ৯৭ লক্ষ টাকা। বোয়ালখালি বাজারের প্রায় সব ব্যবসায়ী এই হামলার সাথে জড়িত ছিল এবং হামলার সময় আগুন ধরিয়ে দেয়ার জন্য সাদা গান পাউডার ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

মাইনি ব্রিজের ঘটনা, ধন রঞ্জন চাকমার মৃত্যু
দীঘিনালা সদরে পাহাড়িদের ওপর হামলা ও তাদের দোকানপাটে আগুন দেয়ার প্রতিবাদে হাজার হাজার পাহাড়ি দীঘিনালা-বাবুছড়া সড়কে নেমে পড়ে। সবচেয়ে বেশি জমায়েত হয় মাইনি ব্রিজ এলাকায়। জমায়েতে অংশ নেয়া যাদুমনি চাকমা নামে একজনের ভাষ্য মতে, বাঙালিদের হামলা থেকে রক্ষার জন্য লোকজন শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার সময় ১০-১২ জন সেনা সদস্য উপস্থিত হয়ে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করলে অনেকে পেছনে সরে পড়লেও আবার অনেকে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। পরে কবাখালির দিক থেকে আরও দুই গাড়ি আর্মি এসে তাদেরকে ধাওয়া করতে থাকলে তারা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। এতে উদোলবাগান গ্রামের বাসিন্দা ধনরঞ্জন চাকমা আর্মিদের হাতে ধরা পড়েন।

সেনারা মধ্যযুগীয় নির্যাতনের পর ধন রঞ্জন চাকমাকে গুরুতর জখম অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। পরে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তিনি মারা যান। ফাইল ছবি

যাদুমনি চাকমা জানান, “আর্মিরা ধনরঞ্জন চাকমাকে ভীষণভাবে মারধর করে, বন্দুকের বাট-বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে এবং আহত অবস্থায় তাকে কলাবাগান নামক স্থানে আশ্রমের পাশে ফেলে রেখে চলে যায়। আমরা চার জন গিয়ে দেখি সে উলঙ্গ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে, তার এক হাত ভাঙা, ওঠ কাটা; তবে তখনও দম ছিল। আমরা তাকে দ্রুত দীঘিনালা হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করি।”

দীঘিনালা হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা তাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে রেফার করেন। রাত সাড়ে দশটার দিকে ধন রঞ্জনকে এমবুলেন্সে করে খাগড়াছড়ি নেওয়ার পথে সেনাবাহিনী ও সেটলাররা তিনটি স্থানে আটকায়। এতে হাসপাতালে পৌঁছতে দেরী হয়ে যায়। পরে রাত দেড়টার দিকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ধনরঞ্জন মারা যান।

নারাঙহিয়ে-স্বনির্ভর এলাকায় সেনাবাহিনীর হামলা-গুলি
দীঘিনালা হামলার প্রতিবাদ জানাতে এবং এলাকায় যাতে দীঘিনালার মতো হামলার ঘটনা না ঘটে সেজন্য পাহারা দিতে রাতে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে হাজার হাজার পাহাড়ি ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে পড়ে। তারা এলাকা পাহারা দেয়ার পাশাপাশি সড়ক অবরোধ করে দীঘিনালা হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর একটি দল নারাঙহিয়া রেডস্কোয়ার ও উপালী পাড়া এলাকায় উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে ফাঁকা গুলি ও পরে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকজন আহত হন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতা আরো বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরে রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার সময়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্বনির্ভর এলাকায় গিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সামনে রাস্তায় বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। সেনাদের গুলিতে কলেজ ছাত্র জুনান চাকমা (২২) ও রাজমিস্ত্রী রুবেল ত্রিপুরা (২৪) নিহত হন এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে আরো ২১ জন গুরুতর আহত হন। এছাড়া সেনারা নারাঙহিয়া এলাকার মুরুব্বী আশীষ চাকমাসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে নিয়ে যায়। অবশ্য পরে তাদেরকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেনাদের এই গুলির ঘটনায় সেদিনের রাতটি এক ভয়ঙ্কর রাতে পরিণত হয়।

খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত ব্যক্তিদের কয়েকজন (উপরে) ও নিহত জুনান চাকমা (বামে) ও রুবেল ত্রিপুরা (ডানে)। ফাইল ছবি


রাঙামাটিতে সেটলারদের হামলা
দীঘিনালা ও খাগড়াছড়িতে সেনা-সেটলার হামলার প্রতিবাদে “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” রাঙামাটি শহরে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। মিছিলটি সকাল পৌনে দশটার দিকে জিমনেসিয়াম থেকে শুরু হয়ে বনরূপা পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত যায়। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় সেটলার বাঙালিরা মিছিলের পেছন দিকে হামলা চালায়। মিছিলে ১,৫০০-২,০০০ জন অংশ নেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, প্রথমে একজন বাঙালি ছেলে মসজিদে ঢিল ছোঁড়ে। তারপর মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় চাকমারা মসজিদ আক্রমণ করছে। এরপর বাঙালিরা সংঘবদ্ধভাবে পাহাড়িদের মিছিলের ওপর হামলা চালালে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পাহাড়িরা বিজন সরণী ও কালিন্দীপুরসহ যে যেদিকে পারে পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়।

হামলাকারী সেটলাররা কালিন্দীপুরে কাপ্তাই কর্ণফুলি কলেজের ছাত্র অনিক কুমার চাকমাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ হত্যার ঘটনায় ফিশারির বাসিন্দা সিএনজি চালক জাহাঙ্গীর ও এসএ পরিবহনের কর্মচারী (পার্সেল বিলিকারী) ইসমাইলসহ ৭-৮ জন সেটলার বাঙালি জড়িত ছিল বলে জানা যায়।

এছাড়া এ হামলায় অন্তত ৬৯ জন পাহাড়ি আহত হন। এছাড়া সংঘর্ষ চলাকালে বাঙালিদের মধ্য থেকেও কয়েকজন আহত হন।

২০২৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরে সেটলারদের হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও অনিক চাকমাকে হত্যার চিত্র। ফাইল ছবি

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় রিগ্যাল ফার্নিচার শো রুম, রাঙামাটি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হোটেল গ্রান্ড মাস্টার, পেট্রোল পাম্প, রূপালী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও সীমান্ত ব্যাংক, রাসেল স্টোর, ডিডিএন নেটওয়ার্ক-এর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনরূপা, দক্ষিণ কালিন্দীপুর, বিজন সরণি, উত্তর কালিন্দীপুর ও হাসপাতাল এলাকার ছোটবড় অন্তত ১০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাঙালি সেটলাররা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিসেও হামলা করে এবং গ্যারেজে রাখা ৯টি গাড়ি ও একটি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া ছয়টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ছয়টি ট্রাক ও তিনটি বাসে ভাংচুর এবং দুটি বেবিট্যাক্সি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১৮টি বসতবাড়ি, ৮৯টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ৮৫টি ভাসমান দোকানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ও একটি বৌদ্ধ বিহারে ভাংচুর করা হয়। একটি হিসেবে হামলায় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৯,২২,৪৫,০০০ টাকা।

সেটলাররা কাঁঠালতলিতে মৈত্রী বিহার ও তবলছড়িতে আনন্দ বিহারেও হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। হামলাকারীরা মৈত্রী বিহার থেকে দুটি দান বাক্সসহ অন্য তিনটি দান বাক্সের টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

প্রতিবাদ

দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সহিংস হামলার পর ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে। ঢাকায় ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে “বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতা” পার্বত্য চট্টগ্রামে ৭২ ঘন্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ডাক দেয়। ইউপিডিএফ এতে পূর্ণ সমর্থন দেয়।

হামলার প্রতিবাদে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, অরুণাচল, দিল্লি, ফ্রান্স, আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া. কানাডা ও শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু এক বছরেও ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এ ভয়াবহ হামলা-হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিচারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টও এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

এই বিচারহীনতা পাহাড়িদের ওপর সেনা-সেটলার হামলায় বড় ধরনের উৎসাহ যোগায়। অপরাধ করেও যদি কেউ শাস্তি না পায়, তাহলে সে আরও অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অতীতের ফ্যাসিস্ট সরকারগুলোর আমলে পাহাড়িরা যেমন ন্যায়বিচার পায়নি, একইভাবে গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকেও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন পাহাড়িরা। এমতাবস্থায়, পাহাড়িদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রাম ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More