চাঞ্চল্যকর সাত খুনের আপিল রায়ের আড়ালে ‘ঢাবি কালো দিবস’: ফিরে দেখা পাক হানাদার-উত্তরসূরীদের তাণ্ডবলীলা!
।। মন্তব্য প্রতিবেদন ।।
আজ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়া জুড়ে প্রাধান্য পেয়েছে হাইকোট কর্তৃক নারায়নগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের আপিলের রায় বহালের খবর। এতে অন্য একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অনেকটা আড়ালে পড়েছে বলা যায়। সেটি ২০০৭ সালে সেনা মদদপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংঘটিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর নিষ্ঠুর বর্বরোচিত নির্যাতনের ঘটনা। বলতে গেলে এত বড় একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদ মাধ্যমে স্থান পায় নি। সযত্নে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। এর পেছনের কারণ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার আর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি-সমিতি, প্রচার মিডিয়া, রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের নানা হিসাব-নিকাশ।
‘২৩ আগস্ট’ কাল দিবস হিসেবে পালন করে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে রচিত হয় এ কলঙ্কিত দিন। ওই বছর ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ছিল আন্তঃবিভাগীয় ফুটবল খেলা (লোক প্রশাসন ও সাংবাদিকতা বিভাগের মধ্যে)। মাঠের পাশে ছিল সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। শিক্ষার্থীরা খেলা দেখতে জড়ো হয়েছিল গ্যালারিতে। মাঠে ঢুকে সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা ছাত্রদের গ্যালারিতে আসন দখলে নিতে চাইলে এ নিয়ে ক’জন শিক্ষার্থীর সাথে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ওপর হাত তোলে। এমনকী কয়েক জন শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায়। মাঠে উপস্থিত ছাত্ররা তার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানায়। ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর মোবাশশ্বর মোনেম সেনা সদস্যদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন। সেনা সদস্য কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গায়ে হাত তোলার খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে বেড়িয়ে আসে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামে স্থাপিত অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প ঘেরাও করে। ছাত্রদের নিকট দোষী সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যদের ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায়। তা মেনে নেয় নি সেনা সদস্যরা। তাতে অবস্থা দাঁড়ায় অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়ার মত!

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারসহ দোষী সেনা কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবিতে সাধারণ ছাত্ররা স্বতস্ফূর্তভাবে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। বিক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও। তা এক উত্তাল তরঙ্গের সৃষ্টি করে। সারা দেশে ‘সেনা হটাও’ আওয়াজ তুলে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। জরুরি অবস্থার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ২১ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসে। তখন পুলিশ তাদের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। নীলক্ষেত, টিএসসি ও কার্জন হল এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সারাদিন থেমে থেমে ছাত্রদের সাথে সংঘর্ষ হয়। পুলিশের টিয়ার শেল আর রাবার বুলেটে আহত হন কয়েক শতাধিক ছাত্র। উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের মুখে সেনা কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামে স্থাপিত অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ২২ আগস্ট দেশের গোটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ দিন রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এক রিক্সা চালক। পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিতে দেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দিনই দেশের পাঁচটি বিভাগীয় শহরে কারফিউ জারি করে। সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলের ছাত্র-ছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ঢাকায় বাসা না থাকায় অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখে পড়ে। রাস্তাঘাট, বাস কাউন্টার, রেল স্টেশন, লঞ্চ ঘাট সর্বত্র ওঁৎ পেতেছিল গোয়েন্দা আর সেনা-বিডিআর-পুলিশের লোকজন। তাদের নির্দেশ ছিল পরিচয়পত্র দেখে দেখে ছাত্রদের নির্যাতন চালাতে। বহু ছাত্র বাড়ি ফেরার পথে নিষ্ঠুর সেনা নির্যাতনের শিকার হয়। রেহাই পায় নি ছাত্রীরাও, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনেক ছাত্রী সেনাদের হাতে নিগৃহীত হয়। শাহবাগে আজিজ মার্কেটের ওপরে ব্যাচেলর মেসসমূহেও অভিযান চালিয়ে সেনা-পুলিশ ছাত্রদের ধরে নির্যাতন চালায়।
পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষক ও সাত ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র আন্দোলনে মদদ দেয়ার অভিযোগে শিক্ষক গ্রেফতার দেখানো হয়। সারাদেশে ৮২ হাজার ছাত্রকে আসামী করে পুলিশ মামলা দেয়, যা পাকিস্তান আমলেও দেখা যায় নি।
২৩ আগস্ট রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ, শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন, কলা অনুষদের সাবেক ডিন সদরুল আমিন ও প্রফেসর নিম চন্দ্র ভৌমিককে সেনা-পুলিশ চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। দেশের সম্মানিত শিক্ষকগণ সেনা হেফাজতে অপদস্থ ও অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন। যা ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ২০১১ সালে উক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত এক তদন্ত কমিটিতে দেয়া সাক্ষ্যে খোমেনী ইহসান (আন্দোলনে যুক্ত) সেনা দমন-পীড়নকে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের সাথে তুলনা করেছেন। (বিস্তারিত দেখুন : http://onlinebangla.com.bd/post/10655/আগস্টরে-ছাত্র-আন্দোলন:-খোমনেী-ইহসানরে-সাক্ষ্য) । ঘটনার ৬৬ দিন পর খুলে দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ঘটনার আড়ালের ঘটনা হলো এই, তখন সেনাবাহিনীর মধ্যেই দেখা দিয়েছিল বিরোধ। সেনা প্রধান মইনুদ্দিন আহম্মেদ আর নবম ডিভিশনের (সাভারে অবস্থিত) জিওসি মাসুদ চৌধুরীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র রূপ নিতে যাচ্ছিল। ছাত্র আন্দোলন দমনের উছিলায় সেনাবাহিনীতে মইনুদ্দিন ক্ষমতা সংহত করতে সমর্থ হন। এতে ভূমিকা রাখেন ব্রিগেডিয়ার বারী নামে এক সেনা কর্মকর্তা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তারা প্রণয়ন করেছিলেন নীলনক্সা।

এখানে মনে রাখা দরকার, ২০ আগস্ট সূচিত ছাত্র আন্দোলনই সেনা সমর্থিত সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। তা না হলে সেনাবাহিনী দেশের শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করতো, সে লক্ষ্যে নীলনক্সা মাফিক গোয়েন্দা চক্র সকল আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছিল। সেনা প্রধান মইনুদ্দিন আহম্মেদ সরকার প্রধান হবার দৌঁড়ঝাপও শুরু করেছিলেন, তার আলামত বিভিন্ন কর্মকা-ে পরিলক্ষিত হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবে একজন শিক্ষিত মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন সেনাবাহিনী ২০০৭ সালে এভাবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবর্ণনীয় নির্যাতন করলো? পাঞ্জাবিরা ’৭১-এ সালে নির্যাতন করেছিল, তারা বাঙালিদের অবিশ্বাস করতো। বাঙালি হয়েও স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনী কেন তা করলো?
আসল কথা হলো, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আদলে। সে কারণে পাক বাহিনীর মতই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যকার একটি গোষ্ঠী নিজেদের সর্বেসর্বা মনে করে। তাদের মনঃপুত নয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। আইন-আদালত, বিচার ব্যবস্থা কোন কিছু তারা পরোয়া করে না। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুুজিবকে সপরিবারে হত্যা, ইনডেমনিটি বিল (দায়মুক্তি আইন) প্রণয়ন– থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মূলেও রয়েছে এ মানসিকতা। এদিক দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনবাহিনীর সদস্যরা হলো পাক হানাদার বাহিনীর যোগ্য উত্তরসূরী! এরা পার্বত্য চট্টগ্রামে উপভোগ করছে দানবীয় ক্ষমতা। ২০১৪ সালের ২০ এপ্রিল নারায়নগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের আসামীদের ফাঁসির রায় ঘোষিত হলেও (আসামী একজন লে. কর্ণেল পদ মর্যদারা সেনা কর্মকর্তা), পার্বত্য চট্টগ্রামে এ বছর ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল পিসিপি কর্মী রমেলকে হত্যা-পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলার আসামী লে. কর্ণেল বাহালুল আলম ও মেজর তানভিরের মামলা থানা গ্রহণ করে নি। বিশেষ সূত্রে প্রকাশ, সেনা হুমকির মুখে রাঙ্গামাটি কোর্টে রমেল হত্যার মামলা বাতিল হয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানপন্থী সেনা কর্মকর্তাদের বেআইনী অপরাধমূলক তৎপরতার কাহিনী দীর্ঘ। ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির বগাছড়িতে সেনা সদস্য কর্তৃক পেট্রোল ঢেলে পাহাড়িদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার মত গুরুতর অপরাধের কোন বিচার হয় নি, যা ছিল প্রকারান্তরে বিজয় দিবসের উৎসবে কালিমা লেপন।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দেশে-বিদেশে বহুল আলোচিত নারায়নগঞ্জে র্যাব কর্তৃক সাত জনকে অপহরণ, নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ২২ আগস্ট দেয়া হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায়, তা হলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে।’ এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না, হাইকোর্টের এ পর্যবেক্ষণ ১৯ এপ্রিল ২০১৭ রমেল হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এখানে শুধু বিচার বিভাগ নয়, সরকার-প্রশাসন দিন দিনই পার্বত্যবাসীর নিকট গুরুত্বহীন, অকেজো ও অপ্রয়োজনীয় সংস্থায় পর্যবসিত হতে চলেছে, তা আমলে না নিলে এর পরিণাম গুরুতর হতে বাধ্য! যার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে ক্ষমতাসীন সরকারকে।#
————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।