দীঘিনালায় শহীদ ভরদ্বাজ মুনি’র ৩২তম আত্মবলিদান দিবসে স্মরণ সভা

দীঘিনালা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পার্বত্য চট্টগ্রামের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ভরদ্বাজ মুনির ৩২তম আত্মবলিদান দিবসে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ ১৩ অক্টোবর ২০২৪, রবিবার সকালে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম (ডিওয়াইএফ) যৌথভাবে এই স্মরণ সভার আয়োজন করে।
স্মরণসভা শুরুর আগে শহীদ ভরদ্বাজ মুনির স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তববক ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এতে ইউপিডিএফ ও গণসংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে যথাক্রমে মিল্টন চাকমা, হিজল চাকমা, মেনাকি চাকমা, রিটন চাকমা ও দীপন চাকমা, শহীদ পরিবারের পক্ষে ভরদ্বাজ মুনির ছেলে দয়া মোহন চাকমা ও বিটন চাকমা স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় ‘শহীদ ভরদ্বাজ মুনির রক্ত বৃথা যেতে দেবো না, আমাদের সংগ্রাম চলছে চলবে’ শ্লোগান দেওয়া হয়।

শ্রদ্ধা নিবেদেন শেষে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শুরুতে শহীদ ভরদ্বাজ মুনিসহ সকল শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
স্মরণসভায় পিসিপির দীঘিনালা উপজেলা সহসভাপতি সুলেন চাকমার সভাপতিত্বে ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সদস্য অর্পনা চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ৪ নং দীঘিনালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা, ইউপিডিএফের দীঘিনালা ইউনিটের সমন্বয়ক মিল্টন চাকমা ও পিসিপি’র বাঘাইছড়ি শাখার সভাপতি প্রকাশ চাকমা।

চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা বলেন, ১৯৯২ সালের আজকের এই দিনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সমাবেশের অংশগ্রহণ করতে এসে ভরদ্বাজ মনি চাকমা শহীদ হন। তাকে আমাদের অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ সময় ধরে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লড়াই সংগ্রাম চলমান রয়েছে। এই আন্দোলনে সবাইকে অংশ নিতে হবে।
যারা লড়াইয়ের শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে এ যাবত অনেকে মারা গেছেন। সরকারকে পাহাড়িদের অধিকারের দাবি মেনে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেয়া দরকার।

চন্দ্র রঞ্জন চাকমা পাহাড়িদের জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, নিজ জাতির মধ্যে ঐক্য না থাকায় পাহাড়িরা আজ সঠিক পথ হারাচ্ছে। এতে জাতিগতভাবে পাহাড়িরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই সকল বিভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যের কাতারে এসে জাতিকে মুক্ত করার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
ইউপিডিএফ নেতা মিলটন চাকমা বলেন, শহীদ ভরদ্বাজ মনি’র আত্মবলিদানের আজ ৩২ বছর পূর্ণ হলো। যারা আজকে এ সভায় উপস্থিতি হয়েছেন হয়তো অনেকে এ ঘটনা সম্পর্কে জানবে না। কারণ ৩২ বছর কম সময় নয়। ১৯৯২ সালের আজকের এই দিনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আহূত সমাবেশে যোগ দিতে এসে ৭০ বছর বয়স্ক ভরদ্বাজ মুনি চাকমা শহীদ হয়েছিলেন। আমাদের যদি অধিকার প্রতিষ্ঠা হতো তাহলে এ দিনটি আরো ব্যাপকভাবে স্মরণ করা যেতো।
তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রীয় মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো বহু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে কাউখালী, লংগদু, লোগাঙ, নান্যাচর ঘটনা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এসব ঘটনা বিষয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে। এদেশের শাসকগোষ্ঠি পাহাড়িদের নিশ্চিহ্ন করতে কী ভয়াবহ নীলনক্সা বাস্তবায়ন করে এসেছে এবং এখনো করছে তা নিয়ে নতুন প্রজন্মের ছাত্র সমাজ, যুব সমাজ ও নারী সমাজকে জানতে হবে। আমরা যদি সঠিক ইতিহাস না জানি তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এসব ঘটনার ইতিহাস একদিন মুছে যাবে। তাই ইতিহাস জেনে এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রজন্মকে জাতিকে রক্ষার হাল ধরতে হবে।
মিল্টন চাকমা আরো বলেন, আজকে যে শহীদ ভরদ্বাজ মনিকে স্মরণ করছি ঠিক এ মূহুর্তে জেএসএস সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র লোকজন পানছড়িতে সংঘাত সৃষ্টি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ছাত্রদের ঐক্যের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তারা সংঘাতে জড়িত হয়ে শাসকগোষ্ঠিকে লাভবান করতে চাচ্ছে। তিনি চলমান ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করতে সবাইকে সচেতন ও সোচ্চার হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
পিসিপি নেতা প্রকাশ চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের দুঃখজনক ঘটনা অনেক। যারা জাতির দুর্দিনে জীবন বাজি রেখে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের আত্মত্যাগ বিফলে যাবে না। একদিন নয় একদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে সুবিধাবাদী, দালাল, স্পাইদেরকে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
তিনি বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো আগের মতোই স্বৈরাচারী শাসন জারি রয়েছে। ফলে নানাভাবে এখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা পাহাড়ি ছাত্রদের নির্দলীয় আন্দোলনকে নানাভাবে দমন করার ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
প্রকাশ চাকমা আরো বলেন দেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন ড. ইউনুসের অন্তবর্তিকালীন সরকার বৈষম্যহীন দেশ গড়ার কথা বললেও পাহাড়ের মানুষ কিন্তু চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পাহাড়িদের ওপর নানা নিপীড়ন চলমান রয়েছে। সাম্প্রতিকালে দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের ওপর হামলা, গুলি করে হত্যা ও ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর-লুটপাট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ধ্বংস করে দেয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠির খপ্পড়ে পড়ে যারা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখতে চাচ্ছে জনগণকে তাদেরকে রুখে দিতে হবে।
তিনি শহীদ ভরদ্বাজ মুনির আত্মবলিদান থেকে সাহস সঞ্চার করে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের কাতারে আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।