পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন-নির্যাতন: অন্তর্বর্তী সরকারের দায়হীনতা
সোহেল চাকমা

চব্বিশের জুলাই-অগাস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিক শানসব্যবস্থার অবসান হয়নি। খোদ দেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের নীতি নির্ধারকেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের নীতি নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেননি।
বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও অধিক আমলাতান্ত্রিকতা চর্চা বিগত ষোল বছরের ফ্যাসিস্ট হাসিনার গণবিরোধী শাসনকে দেশের জনগণ যেন পুনঃরায় উপভোগ করছে। যেমন খুশি তেমন সাজো পন্থায় মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতি। মব জাস্টিস কিংবা তৌহিদি জনতার নামে সংঘটিত হচ্ছে ভয়াবহ নৃশংস হামলা। যে আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দেশ্য নিয়ে শ্রমিক-ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থান হয়েছে তা যেন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার পথে। জনসাধারণের আয় বাড়েনি, নিত্যপণ্যের দাম কমেনি, বাজার সিন্ডিকেট পূর্বের অবস্থায় রয়ে গেছে, ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর দাপট বেড়েছে। সবকিছুই গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকারের চোখের সম্মুখেই ঘটছে। গণতন্ত্রমুখী চিন্তার বদলে ভিন্ন জনজাতির ওপর একধরনের কর্তৃত্ববাদী আবহ তৈরী হয়েছে। ব্যর্থতার গ্লানি যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে অন্তবর্তী সরকারকে। জনগণের ওপর আস্থা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতা অন্তবর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার কারণগুলোর মধ্যে একটি। যা দেশের জনজীবনকে বিপন্নের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অন্তবর্তী সরকারের আরেকটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারা। গণ-অভ্যুত্থানের পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ২৪ দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটিতে সেনা-সেটলার কর্তৃক সহিংস হামলায় জুনান-রুবেল-ধনরঞ্জন ও অনিক চাকমাকে হত্যা করা হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পরিকল্পিতভাবে পাহাড়িদের ওপর হত্যাকাণ্ড, বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হলেও বিচার এখনো পর্যন্ত অন্তবর্তী সরকার করতে পারেনি।
গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ঢাকায় এনসিটিবি’র সামনেও পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের ওপর প্রকাশ্যে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দুয়েকজন প্রত্যক্ষ হামলাকারীকে গ্রেফতার করা হলেও যথাযথভাবে বিচার না করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সংখ্যালঘু জনগণের ওপর এরকম পক্ষপাতিত্ব আচরণ আমরা স্বৈরাচারী হাসিনার আমলেও দেখেছি। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে সেনাবাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে ইউনুস সরকার রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারা। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল রাখার কারণও হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া। যা ইউনুস সরকার জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে সেই কাজটি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছে।
দেশের নৈরাজ্যের উপর ভিত্তি করে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ’২৫ যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে দেশজুড়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করা হলেও সমতলে তা এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে অপারেশন ডেভিল হান্ট’কে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে। অপারেশন ডেভিল হান্ট একদিকে যেমন সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেছে অন্যদিকে পাহাড়ে প্রকাশ্যে দুর্ধর্ষ সেনাশাসনের চিত্র আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। গত ৭ মার্চ ’২৫ রাঙামাটির কাউখালীতে সেনাবাহিনীর ব্যাপক লুটপাট, ভাঙচুর তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। সুতরাং সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ও অপারেশন ডেভিল হান্ট সমতলের জনগণের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের ওপর তা যেন এক বিরাট অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সেনাবাহিনী নিজেদের অপকর্মকে ঢাকার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের মধ্যে সংঘাত জিইয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। ইউপিডিএফ ও জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য জেএসএস’র (সন্তু লারমা’র) সশস্ত্র বাহিনীকে ইউপিডিএফ ও জনগণের বিরুদ্ধে প্রক্সি গ্রুপ হিসেবে লেলিয়ে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনগণকে আতঙ্কিত ও ভীত সন্ত্রস্ত রাখার জন্যে এই প্রক্সি গ্রুপগুলো প্রকাশ্যে একের পর এক হামলা, খুন ও জনগণকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের এ বিষয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
দীর্ঘ ১৬ বছর যাবৎ আওয়ামী হাসিনা সরকারের তাঁবেদার হিসেবে কাজ করা জেএসএস (সন্তু) পাহাড়ে নিজেদের একক আধিপত্য বিস্তারের লালসায় এবং শাসকগোষ্ঠীর ধড়পাকড় এড়াতে এখনো জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে সেনাবাহিনী তথা শাসকগোষ্ঠীর সহচর হিসেবে কাজ করছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারকামী জনগণের জন্য ভয়াবহ অশনি সংকেত! পাহাড়িদের সামগ্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শাসকগোষ্ঠীর কূটচালে পা না দিয়ে জেএসএসকে অতিসত্বর ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের নীতি থেকে সরে আসা প্রয়োজন। না হলে শাসকগোষ্ঠীর জাত বিধ্বংসী খেলায় অদূর ভবিষ্যতে জেএসএস নিজেই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন পৃথিবীর ইতিহাসে জনগণই অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষমতার উৎস এবং ইতিহাস নির্ধারক।
একইভাবে জনগণের সুরক্ষার বদলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গণবিরোধী এমন হীন তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে বসবাসরত জনজাতি ও দেশের জনগণের জন্য ভবিষ্যতে তা ভয়াবহ হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, আধিপত্যবাদী চিন্তা ও বাঙালিত্বে একিভূতকরণ লালসার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারহীন জনজাতি বারবার উপেক্ষিত, নিপীড়িত ও শোষিত হচ্ছে! সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান না করলে দেশে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা কিংবা গণতন্ত্রের জিগির তোলা বুলি আওড়ানো মাত্র। সুতরাং, জনগণের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে যে সরকার ক্ষমতায় আসুক না কেন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে জনজাতি, জনগণের ওপর শোষণ নিপীড়নের দায় কেউ এড়াতে পারবে না, এমনকি ইউনুস সরকারও না।
* সোহেল চাকমা, সহ-সাধারণ সম্পাদক, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটি।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।