মন্তব্য প্রতিবেদন

পাহাড়ে ক্ষমতাবানরা আর কত কাল আইনের উর্ধ্বে থাকবে?

0
ছবি: উপরে বামে খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার ও পরে আনসারের মহাপরিচালক আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ (১ম ও ২য়), খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার মো. আমান হাসান (উপরে ডানে, বর্তমানে অন্যত্র বদলী), নীচের বাম থেকে বর্তমান গুইমারা ব্রিগেড কমান্ডার আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দিন রানা, বর্তমান খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার হাসান মাহমুদ ও রাঙামাটি ব্রিগেড কমান্ডার নাজমুল হক।


মন্তব্য প্রতিবেদন



জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গতকাল (১৭ নভেম্বর ২০২৫) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে। ট্রাইব্যুনালের এই যুগান্তকারী রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, ‘এই রায় ও সাজা একটি মৌলিক নীতিকে পুনর্নিশ্চিত করেছে – যত ক্ষমতাবানই হোক, কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়।’ ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য এই রায় সীমিত মাত্রায় হলেও ন্যায়বিচার এনে দিয়েছে বলে তিনি এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেছেন।

সভ্য সমাজের নিয়ম হলো কেউ অপরাধ করলে বিচারের মাধ্যমে তার শাস্তি হবে; অপরাধের শিকার ব্যক্তি ন্যায়বিচার পাবে। কিন্তু এই নিয়ম কি পার্বত্য চট্টগ্রামে চালু আছে? ড. ইউনূস যে নীতির কথা বলেছেন, তা কি পাহাড়ে প্রয়োগ হচ্ছে? পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ক্ষমতাবানরা হামেশা অপরাধ সংঘটন করে চলেছে, মানবাধিকার হরণ করে চলেছে, তাদের তো কোন শাস্তি হতে আমরা দেখি না। অতীতেও যেমন তাদের শাস্তি হওয়ার নজীর ছিল না, বর্তমানেও নেই।

জিয়া, এরশাদ, খালেদা ও হাসিনা আমলে সংঘটিত গণহত্যাসহ অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বাদ, খোদ শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. ইউনূসের আমলে পাহাড়ে যে সাম্প্রদায়িক হামলা, গণহত্যা ও খুনের ঘটনা ঘটেছে, তারও তো কোন বিচার ও শাস্তি হচ্ছে না। ক্ষমতাবানরা এখানে এখনও আইনের অনেক উর্ধ্বে রয়ে গেছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির গুইমারায় নির্বিচার গুলি চালিয়ে ও পিটিয়ে গুইমারা ব্রিগেডের সেনারা মারমা জাতিসত্তার তিন যুবককে হত্যা করে। এই হত্যার ঘটনায় আজ পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এমনকি পুলিশের দেয়া মামলায় কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। যারা এই হামলা ও খুনের সাথে জড়িত তারা অনেক ক্ষমতাবান। তাই আইন তাদের নাগাল পায় না।

গুইমারা হামলার এক বছর আগে ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা ও খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনী তিন পাহাড়িকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছিল। তার পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি শহরে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার সময় সেটলাররা পিটিয়ে অনিক চাকমা নামে এক কলেজ শিক্ষার্থীকে খুন করেছিল। ওই দুই দিনের সাম্প্রদায়িক হামলায় দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়েছিল। এসব হামলা ও খুনেরও আজ পর্যন্ত বিচার হলো না। তদন্তু রিপোর্টও আলোর মুখ দেখল না। ইউনূস সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি ও “ক্ষত বহনকারী” পাহাড়ি পরিবারগুলোর জন্য সামান্যতম ন্যায়বিচার এনে দিতে পারেননি।

এটা প্রমাণিত সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষমতাশালীরা গণহত্যা, এথনিং ক্লিনজিং-এর মতো মানবতাবিরোধী জঘন্যতম অপরাধ করলেও তার কোন বিচার হয় না। এখানে আইন কেবল কেতাবে আছে, প্রয়োগে নেই। আদালত আছে, কিন্তু ন্যায়বিচার নেই। ক্ষমতাবানরা ভয়ানক অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়, তাদের কোন শাস্তি হয় না। কারণ এখানে একচেটিয়াভাবে চলে সেনা রাজত্ব।

পাহাড়িদের ওপর দমনপীড়নকে বৈধতা দিতে একটি মিথ্যা প্রচার চালানো হয়: পাহাড়িরা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়। কিন্তু আদতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কারা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে? কারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশী নাগরিকদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এ অঞ্চলকে বিদেশীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে? ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারী করা ১১-দফা নির্দেশনার একটি হলো, “কোন দেশী-বিদেশী ব্যক্তি/সংস্থা কর্তৃক পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতীয়দের সাথে সাক্ষাত কিংবা বৈঠক করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী/বিজিবি এর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।” এই নির্দেশনার মাধ্যমে পাহাড়িদেরকে এদেশের জনগণ থেকেও বিচ্ছিন্ন করে রাখছে কে? ড. ইউনূসের গঠন করা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে, অথচ ইউনূস সরকার তার (আসাদুজ্জামান খান কামালের) জারি করা সংবিধানের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী ও পাহাড়িদের জন্য চরম অবমাননাকর উক্ত ১১ দফা নির্দেশ বহাল রেখেছেন।

পাহাড়িরা অবশ্যই স্বায়ত্তশাসন চায়। কিন্তু সেটা চায় বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে এবং জাতীয় সংবিধানের অধীনে। স্বায়ত্তশাসন সব সময় একটি রাষ্ট্রের ভেতরে কোন একটি বা একাধিক অঞ্চলকে দেয়া হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে সংখ্যালঘু জাতির জনগণ বিভিন্ন মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে থাকে। আমরা বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই, যে দেশে গণতন্ত্র যতবেশি ব্যাপক, সেদেশে সংখ্যালঘু জাতিগুলোর স্বায়ত্তশাসনের মাত্রাও ততবেশি উঁচুতে। অর্থাৎ একটি দেশের গণতন্ত্রের অন্যতম মাপকাটি হলো সে দেশের সংখ্যালঘুদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের ব্যাপকতা। এই দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার একটি প্রমাণ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের অনুপস্থিতি।

গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার হাত ধরাধরি করে চলে। কোন দেশে একটির অস্তিত্ব থাকলে, অন্যটিও থাকবে। হাসিনার আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৃত্যুদন্ড হয়েছে বলে, কিংবা গতকাল হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে বলে এদেশে সবার জন্য ন্যায়বিচার সমানভাবে আছে তা অবশ্যই বলা যাবে না। আমাদের বাংলাদেশে আইন সবার ওপর সমানভাবে প্রয়োগ হয় না। এখানে ন্যায়বিচার সবার জন্য নয়। এখানে কেবল ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবানরা ন্যায়বিচার পায়, সাধারণেরা পায় না, সংখ্যালঘু জাতির জনগণ পায় না, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পায় না।

এদেশে আইন হলো প্রতিপক্ষকে দমনের হাতিয়ার ছাড়া কিছুই নয়। আপনার হাতে যতক্ষণ ক্ষমতা আছে, আপনি শত জঘন্য অপরাধ করেও পার পেয়ে যাবেন। আইনের হাত যতই লম্বা হোক, তা আপনার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পরও এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। আগামী ফেব্রুয়ারীতে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হলেও পরিবর্তন হবে এমন আশা করা যায় না।

আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই যে পর্বতপ্রমাণ অসমতা, তার অবসান হওয়া দরকার। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা হলো সেটাই। কাজেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী (অর্থাৎ সাবেক ক্ষমতাবান) শেখ হাসিনার বিচার ও শাস্তি হলে গুইমারা ব্রিগেড কমান্ডার আবুল কালাম শামসুদ্দিন রানা, ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর জনক ও ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ির স্বনির্ভরে ৭ খুনের সাথে জড়িত আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদের (ইউনূস সরকার এই খুনীকে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে), কিংবা কল্পনা চাকমাকে অপহরণকারী লে. ফেরদৌসের বিচার ও শাস্তি হবে না কেন? পাহাড়ে ক্ষমতাবানরা আর কত কাল আইনের উর্ধ্বে থাকবে? ড. ইউনূস তার ক্ষমতায় থাকার সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দিতে না পারলেও, অন্ততঃ এখানকার ক্ষমতাবানদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে পারেন। (১৮ নভেম্বর ২০২৫)



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More