পিসিপি’র কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে গৃহীত ১২ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবনার বিস্তারিত
সিএইচটি নিউজ ডেস্ক : গত ২৪ – ২৫ আগস্ট ২০১৬ দু’দিন ব্যাপী রাঙামাটিতে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর ২০তম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে ১২ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবনা গ্রহণ করা হয়। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবনাসমূহ গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে হুবহু প্রকাশ করা হলো।
১। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপনিবেশবাদী শাসন
পার্বত্য চট্টগ্রাম বর্তমান বিশ্বের অন্যতম রাজনৈতিক সমস্যা প্রবণ ভৌগলিক অঞ্চল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহু জাতির ও ভৌগলিক অঞ্চলের সমস্যা সমাধান হলেও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক খেলার গ্যাড়াকলে পড়ে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, কুর্দিস্তানের মত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাও সমাধান হয় নি। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর ও কুর্দিস্তানের আন্তর্জাতিক পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মূলে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতি ও ঘৃণ্য ঔপনিবেশিক মানসিকতা প্রধানত দায়ি বলে পিসিপি মনে করে।
পিসিপি পর্যালোচনা করলে দেখতে পায় যে, মানব সভ্যতা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে ক্রমান্বয়ে বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পরিবর্তন হয়েছে। বিশে^র জনগণ পুরাতন রক্ষণশীল ব্যবস্থা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্য থেকে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা থেকে জাতিগুলো মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘৃণ্য নব্য ঔপনিবেশিক উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতি ও শাসন ব্যবস্থা জারি রয়েছে। এখানে সংখ্যাগুরু বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেয়ার চক্রান্ত চলছে।
সম্প্রতি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট পূর্বের শোষণ-নির্যাতনের জন্য স্থানীয় জাতিসত্তাসমূহের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং আরো অধিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের অঙ্গীকার করেছেন। কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাডও পূর্বতন শোষণ-নির্যাতনের জন্য সেখানকার স্থানীয় জাতিসত্তা জনগণের (ধনড়ৎমরহ) কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। পিসিপি এ ঘটনা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামি লীগকে স্মরণ করিয়ে দিতে চায় এবং এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানায়।
২। বৃটিশ কর্তৃক পাহাড়িদের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা স্বীকার
পিসিপি গর্বের সাথে এটা স্মরণ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিসত্তাসমূহের গৌরবজ্জল রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। বহুকাল হতে জাতিসত্তারা স্বাধীনভাবে বসবাস করত। এ ভূখণ্ড ছিল প্রাকৃতিক, নৃতাত্বিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বতন্ত এবং রাজনৈতিক সত্তা ছিল স্বাধীন। উপমহাদেশে বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকারী মুঘলরা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা মেনে নিয়েছিল, যাদের সীমান্ত ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সংলগ্ন। দোর্দ- প্রতাপশালী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ১৭৫৭ সালে বাংলায় ক্ষমতা বিস্তারের পর ১৮ শতকের মধ্যে প্রায় সমগ্র উপমহাদেশ করায়ত্ত করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে পারে নি; যদিও ১৭৭৭ সাল হতে ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত এক দশক আগ্রাসনের জন্য যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল তৎকালীন সময়ে এ অঞ্চলের বীর জনতা। ব্রিটিশরা এ অঞ্চলের জাতিসত্তাসমূহের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৮৬০ সাল থেকে শাসনকার্য তাদের হাতে নিলেও এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যার ফলে ১৯০০ সালে “রেগুলেশন” পাশ করেছিল। যদিও এ আইনের অনেক ত্রুটি ছিল, তা সত্ত্বেও এই আইনে বহিরাগতদের অনুমতি ছাড়া প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। পাকিস্তান আমলে এ ধারাটি বাতিল করে দেয়া হয়, ফলে বহিরাগতদের পাহাড়ে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৩। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে শাসকগোষ্ঠীর নীতি
পিসিপি’র রাজনৈতিক পর্যালোচনায় এটা দৃষ্টিগোচর হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা নিপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জোয়াল থেকে মুক্তি এবং নিজেদের অধিকার ফিরে পাবার আশায় পাহাড়িরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু পাহাড়িরা হতাশ হয় যখন মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেই উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা জাতিগত বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হয়; এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা কুকিছড়ায় পাহাড়িদের ওপর গণহত্যা চালায়। এই জাতিগত বিদ্বেষের বীজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পায় শেখ মুজিবের উগ্র জাতীয়তাবাদের নীতির কারণে। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালে মুজিবের সাথে সাক্ষাৎকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিগণ নিজ জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানালে, মুজিব তা প্রত্যাখান করে পাহাড়িদের “বাঙালি” হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। দাবি থেকে সরে না দাঁড়ালে কয়েক লক্ষ বাঙালি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পাহাড়ে পুনর্বাসনের হুমকিও দেন। পরবর্তীতে মুজিবের যোগ্য উত্তরসূরী জিয়াউর রহমান ও এরশাদ হাজার হাজার সামরিক বাহিনী মোতায়েন ও লক্ষ লক্ষ সেটলার বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে মুজিবের নীল নক্সা বাস্তবায়ন করেন। দেশে নব্বই পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে সরকারের নীতির পরিবর্তন হয় নি। এ ক্ষেত্রে খালেদা-হাসিনা খুব একটা ব্যতিক্রম নন। খালেদা জিয়া আরও এক কাঠি উপড়ে বলতে হয়। তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালে ঢাকার বস্তিবাসীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে তার ঘৃণ্য নীতি জনসমক্ষে ফাঁস করে ফেলেন। অন্যদিকে হাসিনা মুখরোচক নানা আশ^াস দিলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ পর্যন্ত আশা ব্যঞ্জক তেমন পদক্ষেপ নেন নি।
৪। সেনা মোতায়েন ও সেটলার পুনর্বাসনের ফল
দুঃখ, ক্ষোভ ও বেদনার সাথে পিসিপি’র এটাও স্মরণে রয়েছে যে, সেনা মোতায়েন ও সেটলার অনুপ্রবেশের পর আশি ও নব্বই এই দুই দশকে কলমপতি, মাল্যা, লংগদু, লোগাং, নান্যাচরসহ ডজনের অধিক গণহত্যা সংগঠিত হয়। রক্তে রঞ্জিত হয় পাহাড়ের ভূমি; চেঙ্গী, কাসলং নদী বয়ে গিয়েছিল রক্তের স্রোত। হাজার হাজার একর ভূমি বেদখল, বহু নারী ধর্ষণের শিকার, অগ্নিসংযোগ করা হয় শত শত ঘরবাড়িতে। ভারতে শরণার্থী হতে হয় অর্ধ লক্ষাধিক পাহাড়িকে, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় অসংখ্য লোকজনকে। এ সমস্ত লোমহর্ষক ঘটনা স্মৃতিচারণ করে প্রত্যক্ষদর্শীরা এখনো শিউরে ওঠেন। যে সমস্ত জায়গায় ভূমি বেদখল করা হয়েছে, সে সমস্ত জায়গায় এখনো সেটলাররা ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে, তাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের যোগসাজশের কথা শোনা যায়।
৫। পিসিপির উত্থান, চুক্তির অসম্পূর্ণতা
পিসিপি’র রাজনৈতিক পর্যালোচনায় এটাও দৃষ্টিগোচর হয় যে, সীমাহীন নিপীড়ন সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, সৃষ্টি হয়েছিল গণজোয়ার। আর সেই আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। ’৯২ সালে পিসিপি স্বায়ত্তশাসনের ডাক দেয়, যা জনগণ অকুণ্ঠভাবে সমর্থন করে। আন্দোলনের জোয়ার যখন তুঙ্গে, তখন মূল দাবি জলাঞ্জলি দিয়ে সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি ’৯৭ সালে ‘পার্বত্য চুক্তি’র মাধ্যমে সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নও যদি সরকার করে, তাহলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। কারণ চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌলিক সমস্যা- সেনা-সেটলার, ভূমি অধিকার, সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নের সমাধানের উল্লেখ ছিল না। যার ফলে অধিকার প্রতিষ্ঠা দূরের কথা, উল্টো পাহাড়িদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ।
পিসিপি’র এটাও বুঝতে বাকী থাকে না যে, চুক্তিটি দুর্বল হওয়ার কারণে ১৮ বছর পার হলেও, আওয়ামি লীগ তা ঝুলিয়ে রেখেছে। শেখ হাসিনা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সময়ে সময়ে ফাঁপা প্রতিশ্রুতি দেন। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এযাবৎ জেএসএস হাঁকডাক ছাড়া কিছুই করতে পারে নি।
৬। অপারেশন উত্তরণের ফল: সাম্প্রদায়িক হামলা, সেনা নির্যাতন, ভূমি বেদখল
পিসিপি’র নিকট এ সত্য আরও বেশি উন্মোচিত হয়েছে যে, বিতর্কিত ‘পার্বত্য চুক্তির’ পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন অব্যাহত রয়েছে। পূর্বের ‘‘অপারেশন দাবানল”-এর স্থলে ‘‘অপারেশন উত্তরণ” নামকরণ করা হয়েছে মাত্র; ধরপাকড়, শারীরিক নির্যাতন, হয়রানিসহ অহরহ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। চুক্তির পর বর্তমান পর্যন্ত প্রায় ২ ডজনের মতো সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে ২০০১ সালে রামগড়ে হামলা, ২০০৩ সালে মহালছড়ি হামলা, ২০০৮ সালে সাজেকে হামলা ২০১০ সালে সাজেক ও খাগড়ছড়িতে হামলা, ২০১২ সালে রাংগামাটি হামলা, ২০১৩ সালে তাইন্দ্যং হামলা, ২০১৪ সালে বগাছড়ি হামলা উল্লেখযোগ্য। এসব ঘটনার পাশা-পাশি চলেছে ভূমি বেদখলের মহোৎসব। বান্দরবান, মহালছড়ি, মাটিরাংগা, গুইমারা, রামগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় শত শত একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে। সেটলারদের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বাহিনী ক্যাম্প সম্প্রসারণ-নির্মাণ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি অজুহাতে পাহাড়িদের নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ চালিয়ে যাচ্ছে। দীঘিনালায় ২১ পরিবারকে উচ্ছেদ করে এবং হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তরে স্থাপনা নির্মাণ করছে। বান্দরবানের রুমা, থানচি আর জেলা সদরে এভাবে পাহাড়িদের ভূমি অধিগ্রহণ করে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
৭। পঞ্চদশ সংশোধনী ও গণবিরোধী ১১ দফা নির্দেশনা
পিসিপি’র নিকট এটা প্রতিভাত যে, বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, পাকিস্তানী কায়দায় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে নীতি একই। সব সরকারই দমন-পীড়ন জিইয়ে রাখতে চায়। বাংলাদেশের এই উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসকগোষ্ঠীই পাহাড়ে সেনা-সেটলারদের অপরাধের পৃষ্ঠপোষক। বিগত সরকারের সময় ফ্যাসিবাদী আওয়ামী মহাজোট সরকার ২০১১ সালে সংবিধানে “পঞ্চদশ সংশোধনী”র মাধ্যমে ৪৫টির অধিক জাতিসত্তার পরিচয়কে অস্বীকার করে উগ্র ‘‘বাঙালি জাতীয়তা’’ চাপিয়ে দিয়েছে। আর বর্তমানেও একই সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক “১১ নির্দেশনা” জারি করা হয়েছে। এই নির্দেশনা পূর্বের দমন-পীড়নের নতুন ভার্সন রূপে হাজির করা হয়েছে। মূলত এই নির্দেশনার মাধ্যমে অবৈধ সেনা শাসন ও সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অন্যায় কাজকর্মকে বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
পিসিপি উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করে যে, এ যাবৎ পাহাড়ে সীমিত যে গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল, এই নির্দেশনার পর পর তাও সেনা-প্রশাসন কেড়ে নিয়েছে। সভা-সমাবেশে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ। এই হস্তক্ষেপের অংশ হিসেবে খাগড়াছড়িতে সেনা-প্রশাসন গণতান্ত্রিক সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। গত বছর চট্টগ্রামে পিসিপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প- করে দিয়েছিল পুলিশ। আর এ বছর দীঘিনালায় ২০শে মে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ভ-ুল করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। গত ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিন সংহতি দিবসে সেনা-প্রশাসন কর্তৃক বর্বরোচিত হামলা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নিরূপা চাকমাসহ দুজনকে গ্রেফতার এর বড় দৃষ্টান্ত। এটা শুধু পাহাড়ি প্রতিবাদী সংগঠনসমূহের ওপর হামলা নয়, এটা ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের ওপরও আঘাত স্বরূপ। অথচ ফিলিস্তিনিদের সমর্থন জানিয়ে শেখ হাসিনা গালভরা কথা বলেন, সময়ে সময়ে পত্রিকায় বাণী দেন। এই হামলার মধ্য দিয়ে সরকার ও শেখ হাসিনার ঘৃণ্য দ্বৈত নীতি প্রকাশ পায়। পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসবের মত সামাজিক র্যালিতেও (২০১৫ সালে, খাগড়াছড়িতে) হামলা চালিয়ে বানচাল করে দিয়েছিল সেনা-প্রশাসন। এটা নিঃসন্দেহে পাহাড়িদের সমাজ সংস্কৃতির ওপর হামলা।
পিসিপি মনে করে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত “১১ নির্দেশনা” যে কার্যত দমন পীড়নের লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা সবার কাছে স্পষ্ট। পাহাড়ে নিয়োজিত উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গী ভাবধারার সেনা কর্মকর্তরা ‘১১ নির্দেশনায়’ আরো বলিয়ান হয়েছে। এসব উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গী ঘেঁষা সেনাদের নিষ্ঠুর দমনপীড়ন পাক হানাদারদের কথাই মনে করে দেয়। এই নব্য পাকবাহিনীরা রাতে-বিরাতে তল্লাশী, অন্যায় ধরপাকড়, শারীরিক নির্যাতন, আটক, মিথ্যা মামলা দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। জঙ্গী ঘেঁষা সেনারা পরিকল্পিতভাবে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যাতে পাহাড়ে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। দমন-পীড়নের এই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বহু ইউপিডিএফ নেতা কর্মীকে আটক করা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে অনেকে ছাড়া পেলেও ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমা, ক্য হ্লা চিং মারমাসহ অনেক নেতাকর্মীকে অন্যায়ভাবে ধরে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, তাদের জেলে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে ।
৮। উগ্র সাম্প্রদায়িক বাঙালি সংগঠনের কার্যকলাপ
পিসিপি গভীর উদ্বেগের সাথে এটা লক্ষ্য না করে পারে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনানিবাসগুলো বাস্তবতঃ উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গীর আঁতুরঘরে পরিণত হয়েছে। সেনা ছাউনির সাইন বোর্ড সর্বস্ব এই সমস্ত জঙ্গী আস্তানা থেকে কতিপয় পাকস্তানপন্থী সেনা কর্মকর্তা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্ত সেটলার সর্দার, বখাটে সেটলার যুবকদের অর্থ ও উস্কানী-মদদ দিয়ে পরিস্থিতি অশান্ত করে তোলার দূরভিসন্ধিতে লিপ্ত। সম্প্রতি তাদের কর্মকা- থেকে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। গত ২০ জুলাই খাগড়াছড়ি কলেজে পিসিপি কর্মীদের ওপর হামলা, গুরতর আহত করে সেনাদের হাতে তুলে দেয়া তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ক্যান্টনমেন্টে পিসিপি কর্মীদের রাতভর মধ্যযুগীয় কায়দায় শারীরিক নির্যাতন চালানোর পর ২১ জুলাই সকালে তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় সেনা কর্তৃপক্ষ। পুলিশ গুরতর আহত অবস্থায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনার কয়েক দিন পরে একই কলেজে ডিজিএফআই সদস্যসহ তথাকথিত বাঙালি পরিষদ নামধারি সেটলাররা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রদের পিসিপি করতে বারণ করে। কলেজে আড্ডা দিতে নিষেধ করে, নির্দেশ অমান্য করলে হামলার ন্যাক্কারজনক হুমকি দেয়। এতে এটা স্পষ্ট হয় যে, তারা সাম্প্রদায়িক আক্রমণের জন্য সর্বদা ওঁৎ পেতে রয়েছে। সেনা-প্রশাসনের ছত্রছায়ায় তারা খাগড়াছড়ি কলেজে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের জিম্মি করে রেখেছে। কিছুদিন আগে পরীক্ষায় নকল ধরার কারণে তথাকথিত বাঙালি ছাত্র পরিষদের নেতা মাসুম এক পাহাড়ি শিক্ষককে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও শারীরিকভাবে অপদস্থ-হেনস্থা করলেও, কলেজ কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নেয় নি। অভিযোগ রয়েছে সেনা ও এক সাম্প্রদায়িক শিক্ষকের চাপে কলেজ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্র কর্তৃক এ ধরনের আচরণ নারায়নগঞ্জে প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার কাহিনী মনে করিয়ে দেয়। এতে শুধু একজন পাহাড়ি শিক্ষককে অপদস্থ করা হয় নি, এটা পুরো শিক্ষক সমাজকে অপদস্থ করার সামিল বলে পিসিপি মনে করে।
পিসিপি উদ্বেগের সাথে এটাও লক্ষ্যে করে যে, সেনা-প্রশাসনের মদদপুষ্ঠ হয়ে সেটলাররা আইন-আদালত তোয়াক্কা করে না। কারণ আইন লঙ্ঘন কিংবা বেআইনি কাজ করলেও তাদের শাস্তি হয় না, রাষ্ট্র তাদের অপরাধ চাপা দিয়ে রাখে। শুধু তাই নয় অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে তারা সেনা সহযোগিতা পেয়ে থাকে। সেটলাররা বিজয় দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারির মত জাতীয় মহান দিবস পর্যন্ত কালিমা লিপ্ত করতে এ কারণে পরোয়া করে না, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালাতে তারা উৎসাহবোধ করে থাকে। ২০১৪ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বগাছড়িতে পাহাড়িদের বসত বাড়ি অগ্নিসংযোগ করে বিজয়ের উল্লাস এবং এ বছর ২১ ফেব্রয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাস থেকে পাহাড়িদের নামিয়ে বর্বরোচিত হামলা– তারই জলন্ত উদাহরণ। ২০১০ সালে সাজেক ও খাগড়াছড়ি, ২০১২ সালে রাংগামাটি, ২০১৩ সালে তাইন্দ্যং ও ২০১৪ সালে বগাছড়ির হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার বিভৎসতার ক্ষত-বিক্ষতের স¥ৃতি এখনো দগদগে রয়েছে পাহাড়িদের মনে। এর মধ্যে সাজেকে হামলা-অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি সেনারা গুলি করে ২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত হয় নি,দোষী সেনা-সেটলারদের শাস্তি হয় নি।
৯। নারী নির্যাতন
পিসিপি গভীর উদ্বেগের সাথে আরও লক্ষ্য করে যে, দমন-পীড়ন, সাম্প্রদায়িক হামলার পাশাপাশি সমানতালে চলছে নারী নির্যাতন। পাহাড়ে পাহাড়ি নারী, শিশু, কিশোরী সেনা-সেটলারদের কারণে ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। এদের কর্র্তৃক প্রায় সময় নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এছাড়া পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে প্রতিনিয়ত উত্যক্তের শিকার হতে হচ্ছে সেনা-সেটলার দ্বারা। পাহাড়ি নারী ধর্ষকদের বিচার ও শাস্তি হয় না বলা চলে, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের রক্ষার্থে যা যা করণীয় তাই করে থাকে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যার কারণে সেটলাররা এ রকম ঘটনা বার বার ঘটাতে সাহস পাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, পাহাড়ে বহুল আলোচিত কল্পনা চকমাা অপহরণের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌসের শাস্তি না হওয়ায় এটি রাষ্ট্রীয় মদদ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই অন্যরাও তা করতে প্ররোচিত হচ্ছে বলে পিসিপি মনে করে।
১০। ভূমি কমিশন
পিসিপি পর্যবেক্ষণে এটাও দৃষ্টিগোচর হয় যে, চুক্তি পরবর্তীতে ভূমি সমস্যার জন্য একটি ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। শুরু থেকে এ কমিশন ছিল বিতর্কিত। কমিশনের আইনে পাহাড়িদের দীর্ঘ দিনের প্রথাগত দাবিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। চেয়ারম্যানকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, সদস্যরা ছিল নামেমাত্র। তাদের ভূমিকা সামান্যই যা খুবই বিতর্কিত বিষয়। সম্প্রতি কমিশনের আইনের সংশোধন করা হলেও তাতে পাহাড়িদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
১১। সুবিধাবাদী দালাল প্রসঙ্গ
পিসিপি উদ্বেগের সাথে আরও লক্ষ্য করছে যে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সুবিধাবাদী দালালরা শাসকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়ে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য নানা কলাকৌশল অবলম্বন করে চলেছে। তাই জনগণকে বিশেষ করে ছাত্র-যুব সমাজকে তাদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। যে সব ছাত্র-যুবক তাদের খপ্পরে পড়ে গণবিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত রয়েছে, তাদের সরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেয়া দরকার বলে পিসিপি মনে করে।
১২। প্রগতিশীলদের নির্লিপ্ততা
পিসিপি আরও লক্ষ্য না করে পারে না যে, বিশে^র অন্য কোন প্রান্তে অন্যায় সংঘটিত হলে এ দেশের প্রগতিশীল সংগঠনগুলোকে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে দেখা যায়। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান সময়ে যে নির্মম দমনপীড়ন চলছে, সে বিষয়ে এই সংগঠনগুলো মুখে কুলুপ এটেঁ থাকতে দেখে পিসিপি তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বড়ই আশ্চার্য ও ব্যথিত হয়।
১৩। ফ্যাসিস্ট শাসন, সমতলে সংখ্যালঘু নির্যাতন
পিসিপির রাজনৈতিক পর্যালোচনায় এটা দৃষ্টিগোচর যে, সারা দেশে আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট শাসন চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তুলনায় মাত্রায় কম হলেও সমতলের জনগণও ফ্যাসিবাদী শাসনে অতিষ্ঠ। শাসক দলের সন্ত্রাস ও দুর্নীতিতে জনগণ পিষ্ঠ। সরকার দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যা ইচ্ছা তাই করছে। ক্রস ফায়ারের নামে বেআইনিভাবে মানুষ হত্যা করে চলেছে। সরকারের লাইসেন্সে তারা এ কাজ করছে। কুমিল্লা সেনানিবাসে সংঘটিত ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রী তনু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার দোষীরা গ্রেফতার না হওয়ায় সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একদিকে জঙ্গীবাদ মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে, অন্যদিকে জঙ্গী ধুয়া তুলে ও নিরাপত্তার নামে দেশে সরকার ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বাঁশখালিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের নামে স্থানীয়দের ভূমি বেদখলের প্রক্রিয়া চলছে। জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে রামপালে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের পাঁয়তারা চলছে।
একদিকে জনগণের ওপর ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন চলছে, অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর ভূমিদস্যুরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হবিগঞ্জে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার অজুহাতে চা শ্রমিকদেরকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়া চলছে। সমতলেও জাতিসত্তাদের উপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। তাদের ঘর বাড়িতে হামলা ও ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরও নিপীড়ন চলছে। হামলা করা হচ্ছে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপরও। এসব সংখ্যালঘু জাতি ও সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি দলের লোকজনই সবচেয়ে এই জুলুমের জন্য দায়ী। তাই আওয়ামী সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসন রুখতে হলে পাহাড় ও সমতলে স্বমস্বরে আওয়াজ তুলতে হবে বলে পিসিপি মনে করে।
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ছাত্র সমাজের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। ছাত্র সমাজের দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি পিসিপি পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতীয় সমস্যা সমাধান তথা জনগণের আশা আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যেও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
১৪। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবি
‘মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু’ হচ্ছে পিসিপি’র দীর্ঘ দিনের দাবি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি দেয়া হলে, তা বাস্তাবায়নের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তৎকালীন পিসিপি’র সাধারণ সম্পাদকের বরাবরে সরকারি পত্র দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার দাবি বাস্তবায়ন হয় নি। এ দাবিতে পিসিপি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজধানীতে বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশ, ক্লাশ বয়কট, অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করেছে। এ বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি পিসিপি মিছিল সহকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি প্রদান করেছে।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী বছর থেকে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হবে ঘোষণা করেছে। পাহাড়ি জনগণের দীর্ঘ দিনের দাবি সরকার আমলে নিয়েছে দেখে পিসিপি স্বস্তি প্রকাশ করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিলম্বিত এ উদ্যোগকে পিসিপি এই প্রতিনিধি সম্মেলনে সতর্কতার সাথে সাধুবাদ জানাচ্ছে। প্রকৃত শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে এ কাজে পাহাড়ি ও বাইরের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া প্রয়োজন বলে পিসিপি মনে করে। এ ব্যাপারে পিসিপি’র সহায়তা চাইলে পিসিপি সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা কর্তৃপক্ষকে সাধ্যমত সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
‘মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু’ — এ দাবি মান্য না করার কারণে দীর্ঘদিন ধরে পিসিপি রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজিত অনুষ্ঠান (কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পূষ্পস্তবক অর্পণ) বয়কট করে আসছে, এ প্রতিনিধি সম্মেলনে পিসিপি তার সমাপ্তি ঘোষণা দিচ্ছে। এটা পিসিপি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চায় যে, পিসিপি ভাষা শহীদদের প্রতি অকুণ্ঠভাবে শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু শাসকগোষ্ঠী ভাষার দাবিতে আত্মবলিদানকে বিকৃত ও খণ্ডিতভাবে তুলে ধরে থাকে এবং ভিন্ন ভাষা-ভাষীদের অবমাননা করে থাকে, সে কারণে পিসিপি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পূষ্পস্তবক অর্পনসহ রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বয়কটের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিল।

২০ তম প্রতিনিধি সম্মেলনে পিসিপি নিম্মোক্ত রাজনৈতিক প্রস্তাব উত্থাপন করছে,
১। ‘অপারেশন উত্তরণ’ বাতিলপূর্বক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত দমনমূলক ‘১১দফা নির্দেশনা’ অবিলম্বে প্রত্যাহারসহ চলমান ধরপাকড় বন্ধ করার এবং রাজনৈতিক কারণে আটক ইউপিডিএফসহ অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীদের নিঃশর্তে মুক্তি দানের আহ্বান জানাচ্ছে।
২। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬ খসড়া মন্ত্রীসভায় নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়ায় পিসিপি ক্ষোভ প্রকাশ করে তা বাতিলের দাবি জানাচ্ছে। পিসিপি মনে করে, এতে দেশের নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা হবে।
৩। ‘রাবেতা আল-ইসলাম’ নামে রাঙ্গামাটির লংগুদুতে স্থাপিত হাসপাতাল ও ধর্মীয় সংস্থাটির বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জনমনে ভীতি ও সন্দেহ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামি সম্প্রসারণ ও জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠায় সংস্থাটি নিয়োজিত বলে প্রতীয়মান হয়। এ সংস্থাটিকে নিষিদ্ধকরণপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামি সম্প্রসারণ ও জঙ্গী কার্যকলাপ বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানাচ্ছে।
৪। কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌসসহ যে সকল সেনা কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় দুর্নীতি, অবৈধ কাঠ ব্যবসা-চোরাকারবারি-ইয়াবাসহ নানা মাদক পাচার-আইএসআই জঙ্গী কার্যকলাপে সম্পৃক্ত, হত্যাকা- ও মানবতাবিরোধী অপকর্মে যুক্ত তাদের ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িত বিতর্কিত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকতাদের দেশের মিডিয়ায় (পত্র-পত্রিকা ও টিভি টক শো) স্থান না দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
৬। ধর্ষণের মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রদানে গোপন সরকারি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে এ যাবৎ বিভিন্ন ধর্ষণের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছে।
৭। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী পাহাড়ি জনগণের সাথে বাঙালি জনগণের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সেটলারদের জীবিকার নিশ্চয়তাসহ পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহারের (সমতল অঞ্চলে তাদের আদি আবাস ভূমিতে পুনর্বাসন) দাবি পুনর্ব্যক্ত করছে।
৮। পার্বত্য চট্টগ্রাম যুদ্ধপীড়িত বা অধিকৃত অঞ্চল নয়, এখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দখলদার বাহিনীর মত জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। তাছাড়া বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড -ধর্ষণ, মাদক পাচার, অবৈধ কাঠ ব্যবসা, চোরাকারবারি ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে পড়ে সেনা সদস্যদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট বা অন্যত্র ব্যারাকে সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
৯। রাঙ্গামাটিতে স্থাপিত বিতর্কিত মেডিক্যাল কলেজ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা লাভের সুযোগ নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে।
১০। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত ভূমি অধিকার আইনগতভাবে স্বীকৃতি প্রদানপূর্বক পর্যটন-নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প নির্মাণ-সম্প্রসারণ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের নামে ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধের দাবি জানাচ্ছে।
১১। খাগড়াছড়ির আলুটিলায় ইকো ট্যুরিজম প্রকল্পের জন্য ৬৪০ একর জমি অধিগ্রহণের নামে পাহাড়ি (বিশেষত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী) উচ্ছেদ ও বনাঞ্চল ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছে, কারণ এ অঞ্চলের কয়েক হাজার পাহাড়ি অধিবাসী তাদের নিত্যদিনের জীবন জীবিকার জন্য বনের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল।
১২। সুন্দরবনের রামপাল বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণ ২৩ নভেম্বরের মধ্যে বন্ধের ‘তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র বেঁধে দেয়া সময়সীমাকে পিসিপি’র প্রতিনিধি সম্মেলন যৌক্তিক মনে এবং এ দাবির সমর্থনে ঘোষিত ২৬ নভেম্বরের ‘ঢাকা মহাসমাবেশ’-এর প্রতি সমর্থন জানিয়ে সংহতি প্রকাশ করছে। বিদুৎকেন্দ্র স্থাপনের খেসারত ১৯৬০ সালে কর্ণফুলি নদীতে দিতে হয়েছে, তার ভুক্তভোগী হিসেবে পাহাড়ি জনগণ পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র ধ্বংস করে আর এ ধরনের গণবিরোধী প্রকল্প দেখতে চায় না।
——————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।