পিসিপি’র ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকায় আলোচনা সভা, ভিডিও-স্থির চিত্র প্রদর্শন
- সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে চলেছে– আবুল কাসেম ফজলুল হক
[divider style="normal" top="20" bottom="20"]
ঢাকা : বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকায় আলোচনা সভা এবং আন্দোলন সংশ্লিষ্ট ভিডিও-স্থিরচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করেছে পিসিপি।
গতকাল ২০ মে (রবিবার) বেলা আড়াইটায় ঢাকার পল্টনস্থ শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি বিনয়ন চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অনিল চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারন সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনর কেন্দ্রীয় সভাপতি নিরূপা চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এমএম পারভেজ লেলিন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি ইকবাল কবির, প্রগতিশীল ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক রিপন চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুনয়ন চাকমা, ছাত্র ঐক্য ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য আল ফোরকান।
সভার শুরুতে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক সুনীল ত্রিপুরা। এরপর শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ২৯ বছর ধরে সংগ্রামী ঐতিহ্য ধারণ করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ায় পিসিপিকে ধন্যবাদ জানান এবং সংগঠনের এই আপোষহীন সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি আগামী দিনে আন্দোলনকে আরো জোরদার করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকার তিন পার্বত্য জেলায় জনগণের প্রতি একরকম অবিশ্বাস পোষণ করে চলেছে। শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা সবাই সরকার প্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসাধারণকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখেছে। যে কারণে সেখানে ব্যাপক ক্যান্টনমেন্ট নির্মান ও সেনা ছাউনির পর সেনা ছাউনি স্থাপন করে জনগণকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নানা রকম নিপীড়নের মধ্যে রেখেছে। এই অবিশ্বাস কেন? তার একটা কারণ হলো- ১৯৭২ সাল থেকে বলা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বোধহয় বাংলাদেশ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে স্বধীন রাষ্ট্র্র গঠন করতে চায়। এরপর জেএসএস এবং পরে শান্তিবাহিনী গঠন করে দীর্ঘ সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছে। অবশেষে সন্তু লারমার সাথে শেখ হাসিনার মধ্যে একটা এগ্রিমেন্ট হওয়ার পর তার অবসান ঘটেছে।

পার্বত্য চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশের ক্ষমতায় তখন হাসিনা সরকারকে দিল্লী সরকার চিঠি লিখে জানায় তাদের দক্ষিণ পূর্ব রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের বহু নাগরিক রয়েছে, তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে নিন। আর ফিরিয়ে না নিলে তাদের যদি প্রাণ হারাতে হয় তাতে ভারত সরকার দায়ি থাকবে না। এই চিঠি পাওয়ার পর একদিকে শেখ হাসিনা ও অন্যদিকে সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তিবাহিনী, তারা একটি এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটায়। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও বাংলাদেশের কোন সরকারই পাহাড়ি জনসাধারণের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা রাখছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণের প্রতি সরকারের অবিশ্বাস কমেনি। তার প্রমাণ হলো- সেখানে সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও বিজিবি’র সংখ্যা কমেনি এবং তাদের অত্যাচারও কমেনি। সেখানে নারী নির্যাতন থেকে আরম্ভ করে সমস্ত রকমের নির্যাতন ও অবিশ্বাস এখনো চলছে।
ফয়জুল হাকিম বলেন, মার্কস বলেছিলেন “যে জাতি অন্য জাতিকে শাসন-শোষণ করে সে জাতিভূক্ত জনগণ নিজেরাও স্বাধীন নয়”। যে বাঙালি জাতি দেশের প্রায় ৪৫টির অধিক জাতির জনগণকে শাসন-শোষণ করছে ঠিক একইভাবে তারা দেশের কৃষক, শ্রমিক ও বস্তিবাসী বাঙালি জাতির জনগণের উপরও শাসন-শোষণ চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকার জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভয় পায় বলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অগণতান্ত্রিক ১১দফা দির্দেশনা জারি রেখেছে। ইউপিডিএফ-এর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা দায়ের করেছে। সম্প্রতি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সহসভাপতি ও ইউপিডিএফ-এর সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসাসহ শতাধিক নেতা কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এমনকি ঘটনা ঘটেছে রাঙামাটিতে আর সে মামলায় খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলা চেয়ারম্যানদের জড়ানো হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকার ইউপিডিএফ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। সরকার আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার তা করেছে। সরকার দুর্বল হওয়ার কারণে এভাবে গণহারে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার আগামী নির্বাচন এমনভাবে করতে চায়, যাতে অন্য কেউ আর ক্ষমতায় আসতে না পারে। দেশে যে অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় বসে আছে তার বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠনগুলোকে রুখে দাঁড়ানের আহ্বান জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, যে সংবিধান দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার দেয় না এ সংবিধান জনগণের সংবিধান নয়। বাংলাদেশ বহুজাতির দেশ হলেও সংবিধানে তা স্বীকার করা হয়নি।
তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে যে নিপীড়নমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে আমরা তার নিন্দা জানান এবং সেখান থেকে অপারেশন উত্তরণ ও অগণতান্ত্রিক ১১ নির্দেশনা জারি রয়েছে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
মাইকেল চাকমা বলেন, পিসিপি গঠনলগ্ন থেকেই প্রতিবাদী চরিত্র ধারণ করেছে। দীর্ঘ ২৯ বছরে পিসিপি’কে বহু বাধা বিপত্তি ও নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বহু নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন এবং অনেকে এখনো জেলে অন্তরীণ রয়েছেন।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ভূমি সমস্যা। জিয়াউর রহমানের আমলে চার লক্ষাধিক ছিন্নমূল বাঙালি জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করার পর ভূমি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ১৯৯৭ সালে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি ভূমি বিরোধ সমস্যাকে নিষ্পত্তি করতে পারেনি বলে দাবি করেন তিনি। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মূল সমস্যাকে আড়াল করে পাহাড়ি-বাঙালি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে কৃত্রিম সংকট তৈরির ষড়যন্ত্রকে সমালোচনা করে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা পাহাড়ি এবং বাঙালির মধ্যে দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত সমস্যা নয়, এটা রাজনৈতিক সমস্যা। ইদানিং পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে খবরের নামে কতিপয় সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে গুজব রটনো হচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন অর্থ, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও ভারী শিল্প ব্যতীত সকল প্রশাসনিক ক্ষমতা নির্বাচিত সংস্থার নিকট হস্তান্তর করার দাবিসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ইউপিডিএফ’র সুস্পষ্ট দাবিনামা রয়েছে। কিন্তু সরকার তা পাশ কাটিয়ে অঘোষিত সেনাশাসন জারি রাখার মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে অযৌক্তিকভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রেখেছে। অগণতান্ত্রিক ১১ নির্দেশনার মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে পাহাড়ি জনগণের উপর জুলুম নির্যাতন চালানোর রাষ্ট্রীয় লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর ফলে জনগণের দেয়া ট্যাক্সের বিরাট একটি অংশ যেমন অপচয় হচ্ছে পাশাপাশি স্থানীয় জাতিসত্তার জনগণের সাথেও সরকারের দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে।
আলোচনা সভা শেষে আন্দোলন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও ও স্থির চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
_________
সিএইচটিনিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।