প্রধান উপদেষ্টাকে বন্দুকভাঙা এলাকাবাসীর স্মারকলিপি: মারিচুকে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন না করার দাবি
ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
রাঙামাটির বন্দুকভাঙা ইউনিয়নের মারিচুক ও যমচুগ ভাবনা কেন্দ্র পাহাড়ে গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন না করার দাবিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন বন্দুকভাঙা এলাকাবাসী ও যুমচুগ বনাশ্রম ভাবনা কেন্দ্রের উপাসক-উপাসিকা পরিষদ।
রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার মাধ্যমে তারা এ স্মারকলিপি প্রদান করেন। উপদেষ্টার ব্যক্তিগত সচিব স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেন।
স্মারকলিপি প্রদানকালে উপস্থিত ছিলেন- জীবক কুমার চাকম (যমচুগ বনাশ্রম ভাবনা কেন্দ্রের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক), তরুন বিকাশ চাকমা (গ্রাম কার্বরী), কিরণ জ্যোতি চাকমা (ভুক্তভোগী) ও হেমচন্দ্র চাকমা (এলাাকর মুরুব্বী)।

স্মারকলিপিতে তারা বলেন, “আমরা বিভিন্ন সূত্রে অবগত হয়েছি যে, বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের মারিচুক ও যমচুগ ভাবনা কেন্দ্ৰ মোন বা পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ বা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে গত ২ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রি: থেকে উক্ত দুটি স্থানে গ্রামবাসীকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে গ্রামবাসীর বাড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছে।
অত্র ইউনিয়নের অধিবাসীগণ মারিচুক ও যমচুগ ভাবনা কেন্দ্র মোনে বা তার আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনে বিরোধী। ইতিমধ্যে ক্যাম্প স্থাপন না করার দাবীতে এলাকাবাসী মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন”।
এতে তারা মারিচুকে ক্যাম্প না করার আপত্তি জানিয়ে বলেন,
ক) উক্ত স্থানে জমি বেদখল করে ক্যাম্প স্থাপন করা হলে কয়েক পরিবার গ্রামবাসী নিজ বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হবেন। তারা পূর্বে ১৯৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কারণে ভূমিহীন ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছিল। নতুন করে আবার উচ্ছেদ হলে তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। এই জমিতে তাদের লাগানো সেগুন ও ফলমূলের বাগান রয়েছে, ক্যাম্প স্থাপনের কারণে উচ্ছেদ হলে তারা সেগুলোর ভোগদখল থেকে বঞ্চিত হবেন।
খ) গ্রামবাসীরা জীবনধারণের জন্য সব সময় বনের উপর নির্ভরশীল। ক্যাম্প স্থাপন করা হলে তারা বন থেকে লাকড়ি, বন্য তরি-তরকারি-ফলমূল, ঘর নির্মাণের জন্য গাছ-বাঁশ,শন, মেয়েদের কোমর তাঁতের সরঞ্জাম ইত্যাদি দৈনন্দিন ব্যবহার গৃহস্থলির সামগ্রী সংগ্রহ করা থেকে বঞ্চিত হবেন।
গ) ক্যাম্প নির্মাণের জন্য পাহাড়, বন ও গাছপালা কাটার প্রয়োজন হবে। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ওজীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঘ) মারিচুক ও যমচুগ ভাবনা কেন্দ্রের আশেপাশের এলাকায় পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করবে, কারণ এমনিতেই সেখানে গ্রীষ্মকালে ভয়াবহ পানির সংকট দেখা দিয়ে থাকে।
ঙ) এলাকাবাসীর ধর্মচর্যায়ও ব্যাঘাট সৃষ্টি হবে। মারিচুক ও যমচুগ ভাবনা কেন্দ্রে ক্যাম্প স্থাপন করা হলে বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজনের জন্য বিহারে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া ক্যাম্পে যাতায়াতের জন্য সহজ রাস্তা নেই। ক্যাম্পে রসদ সরবরাহের জন্য আকাশ যানের প্রয়োজন হলে হেলিপ্যাড নির্মাণ করতে হবে, এতে প্রতিনিয়ত হেলিকপ্টার ওঠানামার বিকট আওয়াজে পাশের বিহারের ভিক্ষুদের ধ্যানচর্চায় ব্যাঘাট ঘটবে। তাছাড়া তা সরকারের জন্যও হবে বেশ ব্যয়বহুল। এক কথায় মারিচুক ও যমচুগ ভাবনা কেন্দ্রে ক্যাম্প করা হলে তা জনগণের করের টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।
চ) আসলে মারিচুক ও যমচুগ ভাবনা কেন্দ্র মোনে নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপনের আদৌ প্রয়োজন নেই। এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়নি বরং স্বাভাবিকই রয়েছে। তাই ক্যাম্প স্থাপনের জন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এ যাবত কোন দাবী করা হয়নি।
স্মারকলিপিতে তারা সরকারের পক্ষ থেকে বন্দুকভাঙা ইউনিয়নের মারিচুক ও যমচুগ ভাবনা কেন্দ্র মোনে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা বা উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকলে অনতিবিলম্বে তা বাতিলের আবেদন জানান।
স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন, এলাকার কার্বারি তরুণ বিকাশ চাকমা, নলিনী রঞ্জন চাকমা, হিমেল চাকমা ও শান্তি মনি চাকমা।

একই সাথে যমচুগ বনাশ্রম ভাবনা কেন্দ্রে সেনাবাহিনী কর্তৃক ৩০০টি সুপারি গাছ কর্তন করে দেয়ার বিষয়েও আরেকটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, গত ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রি. তারিখে যমচুগ বনাশ্রম ভাবনা কেন্দ্রের মালিকানাধীন জায়গায় রোপিত আনুমানিক ৩০০ (তিনশত) সুপারি গাছ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নানিয়ারচর জোনের একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদবীর কর্মকর্তা জনাব তানভীরের নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা গাছ কেটে ও উপড়ে ফেলে দিয়ে একটি হেলিপ্যাড নির্মাণ করে। হেলিপ্যাড নির্মাণের আগে বিহার পরিচালনা কমিটির সঙ্গে কোন প্রকার যোগাযোগ করা হয়নি। আমাদেরকে না জানিয়ে স্থানীয় নিরীহ কয়েকজন জুমচাষীকে নিয়ে সুপারি বাগান ধ্বংস করতে বাধ্য করা হয়। হেলিপ্যাড নিমার্ণের জন্য ৩০০ (তিনশত) সুপারি গাছের বাগান ধ্বংস করে বিহারের অবর্ণনীয় ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। পবিত্র বৌদ্ধ বিহারের জায়গায় সৃজিত ফলজ বাগান ধ্বংস করায় স্থানীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নরনারীরা চরম ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবার পর আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ একটি গণতান্ত্রিক ও জনবান্ধব সরকারের অধীনে তাদের মুক্ত-স্বাধীন জীবন পার করার জন্য আশাবাদী হয়েছেন। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত এই পাহাড়ি জনপদে সেনাবাহিনীর এমন কার্যক্রম আমরা আশা করিনি। আমাদের পবিত্র বৌদ্ধ বিহারের সুপারি বাগান ছাড়াও হেলিপ্যাড নির্মাণের জন্য ওই এলাকায় বহু পাহাড় রয়েছে। সেসব পাহাড়ে হেলিপ্যাড নির্মাণ না করে আমাদের পবিত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বাগান ধ্বংস করে হেলিপ্যাড নির্মাণ করায় আমরা শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন।
এতে ধ্বংসপ্রাপ্ত সুপারি বাগানে পুনরায় ফলজবাগান সৃজন ও সেখান হেলিপ্যাড সরানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।