বর্মাছড়িতে সেনাবাহিনী কর্তৃক এক ব্যক্তির বাড়ি তল্লাশিকালে জব্দকৃত টাকা এখনো ফেরত দেয়া হয়নি

কামদেব চাকমার বাড়িতে সেনা তল্লাশির চিত্র।
লক্ষীছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ২২ আগস্ট ২০২৫
খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়নের দেওয়ান পাড়ায় গত বুধবার (২০ আগস্ট) ভোররাতে লক্ষীছড়ি জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মো. তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল সেনা সদস্য কামদেব চাকমা, পিতা- মৃত-বলভদ্র চাকমা(সাধু)-এর বাড়িতে হানা দিয়ে ব্যাপক তল্লাশি চালায়। তল্লাশিকালে বাড়ির সকল জিনিসপত্র তছনছ করে দেওয়া হয়।
তল্লাশির শিকার হওয়া ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, তল্লাশির সময় সেনারা তাদের বাড়িতে রাখা নগদ ১১ লক্ষ ৯২ হাজার টাকাসহ জমির দলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।
কামদেব চাকমা বলেন, গাছ বাগান, গরু-ছাগল, বাঁশসহ বিভিন্ন মালামাল বিক্রি করে এবং পরিবারের সবাই মিলে অনেক কষ্টে এই টাকাগুলো উপার্জন করেছি। সেই টাকা সব সেনাবাহিনী নিয়ে গেছে। আমি এখন একেবারেই শূন্য।
কামদেব চাকমা বাড়িতে জমা রাখা টাকার উৎসের হিসাব দিয়ে বলেন- ১। গাছ বাগন বিক্রয় বাবদ- ৬,৫০,০০০ টাকা, ২। গরু ৫টি বিক্রয় বাবদ ৩,০২,০০০ টাকা, ৩। ছাগল ১টি বিক্রয় বাবদ ১৩,০০০ টাকা, ৪। বাইজ্জে বাঁশ ২০০টি বিক্রয় বাবদ ১৩,০০০ টাকা, ৫। বুদ্ধ মূর্তি ক্রয়ের জন্য দেওয়ান পাড়া থেকে উত্তোলনকৃত সামাজিক বাজেট ২১,০০০ টাকা ও ৬। পারিবারিকভাবে বিভিন্ন মালামাল ও পণ্য সামগ্রী বিক্রয় বাবদে ১,৯৩,০০০ টাকাসহ সর্বমোট ১১,৯২,০০০ টাকা।
তবে সেনাবাহিনী ‘৯ লাখ ২৯ হাজার ৫১০ টাকা’ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে, যা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়াও সেনারা গ্যাসের চুলা ১টি, গিটার ১টি, দা ১টি, কামদের চাকমার পিতা মৃত- বলভদ্র চাকমার ব্যবহৃত পুরাতন লাল পাসপোর্ট ২টি (পিতার স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষিত), জমি ও মেয়াদি গাছ ক্রয়ের দলিল, নষ্ট ও সচল বাটন মোবাইল ফোন ৫টি এবং কামদেব চাকমা ও তার ছেলে ডায়মন্ড চাকমার জাতীয় পরিচয়পত্র ২টি নিয়ে যায়।

কামদেব চাকমার বাড়িতে সেনা তল্লাশির চিত্র।
কামদেব চাকমার স্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, বাড়িটি তল্লাশির সময় সেনা সদস্যরা চুপিসারে অনেক টাকা নিজেদের পকেটস্থ করে নিয়েছে। তল্লাশির পর সকালে চলে যাওয়ার সময় জব্দকৃত টাকা ও জিনিসপত্রগুলির জন্য ক্যাম্পে যোগাযোগ করতে বলে যায়।
তাদের কথানুযায়ী ঐদিন (২০ আগস্ট) বিকাল ৪ টার দিকে ৩নং বর্মাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবু সুইচালা চৌধুরীর নেতৃত্বে ভুক্তভোগী পরিবার ও গ্রামের কার্বারী, মেম্বার ও মুরুব্বীরা বর্মাছড়ির শুকনাছড়ি ক্যাম্পে যোগাযোগ করতে যান। তারা সেখানে গেলে তাদের সাথে অভিযানে অংশ নেয়া লে. মোস্তফা দেখা করেন।
এ সময় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কার্বারীরা টাকাগুলো ফেরত দেয়ার জন্য অনুরোধ জানালে লে. মোস্তফা তাদেরকে বলেন, “আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করেছি। আমাদের কাছে তথ্য ছিলো সেখানে ইউপিডিএফের টাকা মজুদ রাখা হয়েছে। জব্দকৃত সকল টাকা ইউপিডিএফের।”
তার কথার প্রেক্ষিতে যোগাযোগ করতে যাওয়া জনপ্রতিনিধি ও মুরুব্বীরা সবাই লে. মোস্তফার কথার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, এসব টাকা ইউপিডিএফের নয়, এগুলো কামদেব চাকমার কষ্টে অর্জিত বৈধ টাকা। সেগুন বাগান, গরু-ছাগল, বাঁশসহ বিভিন্ন মালামাল বিক্রি করে তিনি উক্ত টাকা উপার্জন করেছেন। তার সকল প্রমাণাদি আমাদের কাছে রয়েছে। তাদের যুক্তির সাথে পেরে না উঠলে লে. মোস্তফা বলেন ‘গাছ কাটা বেআইনি। গাছ কাটতে গেলে সরকারি অনুমোদন লাগবে। পারমিট ছাড়া গাছের ব্যবসা ও গাছ কাটা যাবে না’- এমন নতুন যুক্তি খাড়া করেন।
এরপর বর্মাছড়ি ইউনিয়নে ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার ললিত কুমার চাকমা লে. মোস্তফাকে বলেন, ‘আমরা যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় নিজস্ব জায়গায় সৃজনকৃত বাগান থেকে গাছ বাঁশ বিক্রি করে আমাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিখাচ্ছি। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ পরিবারের যাবতীয় খরচপত্র এই গাছ, বাঁশ বিক্রি করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছি।’
মেম্বারের এই যুক্তি শুনে লে. মোস্তফা পরদিন অর্থাৎ ২১ আগস্ট লক্ষীছড়ি জোনে যোগাযোগ করার কথা বলে প্রতিনিধি দল ও ভুক্তভোগীদের বিদায় করে দেন।
তবে তার আগে তিনি ‘যে টাকা ও মালামাল জব্দ করা হয়েছে সেগুলো ইউপিডিএফ এর কাছ থেকে পাওয়া গেছে’ বলে দেখা করতে যাওয়া জনপ্রতিনিধি ও মুরুব্বীদেরকে একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে চাপ দেন। কিন্তু মুরুব্বীরা তাতে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে পরে ‘ইউপিডিএফের কাছ থেকে পাওয়া গেছে’ কথাটি ফ্লুয়িড কলম দিয়ে মুছে দেন। তার পরেই মুরুব্বীরা ওই কাগজে স্বাক্ষর করেন।
লে. মোস্তফার কথানুযায়ী ২১ আগস্ট দুপুর ২:০০টার দিকে লক্ষীছড়ি উপজেলার প্রাক্তন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অংগ্য প্রু মার্মার নেতৃত্বে ৩নং বর্মাছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুইচালা চৌধুরী, মেম্বার ললিত কুমার চাকমা, কালাচান কার্বারী, গরু ব্যবসায়ী শিমুল চাকমা ও মো. মুজিবর লক্ষীছড়ি জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল তাজুল ইসলামের সাথে দেখা করতে যান। তাদের সাথে ভুক্তভোগী কামদেব চাকমা ও তার স্ত্রী সুচীমালা চাকমাও ছিলেন। তবে অসুস্থ থাকার কারণে কামদেব চাকমার কাছ থেকে ১০০টি সেগুন গাছ ক্রয়কৃত বাঙালি ব্যবসায়ী শাহআলম সওদাগর উপস্থিত থাকতে পারেননি।
জোনে গিয়ে প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দ প্রথমে ক্যান্টিনে দায়িত্বরত আরপি ও ডিজিএফআই এর জনৈক সদস্যর সাথে কথা বলেন। তারা জানান যে, ‘সিও স্যার বাইরে আছেন। দেখা করা যাবে না।’ এর পর প্রতিনিধি দলটি চলে আসার সময় ডিজিএফআই-এর জনৈক সদস্য শিলা গেট থেকে ফিরিয়ে নিয়ে তাদেরকে ক্যান্টিনে নিয়ে যান। এ সময় তিনি জানান যে, সিও স্যারের প্রতিনিধি আপনাদের সাথে দেখা করবেন। এর কিছুক্ষণ পরে টু-আইসি জনৈক মেজর এর নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন মো. ফাহাদ, লে. মো. মোস্তফা ও জনৈক লে. সহ মোট ৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল তাদের সাথে দেখা করেন।
শুরুতেই মেজর প্রতিনিধি দলকে কি জন্য দেখা করতে এসেছেন বলে জিজ্ঞাসা করেন। এমন ভাব দেখান যে, যেন তারা কিছুই জানেন না। এরপর অংগ্য প্রু মার্মা দেখা করতে যাওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি ২০ আগস্ট বর্মাছড়িতে কামদেব চাকমার বাড়ি থেকে টাকা জব্দ করার বিষয়টি জানিয়ে বলেন, ঐ টাকাগুলো কামদেব চাকমার নিজস্ব উপার্জিত টাকা। তাই সে টাকাগুলো ফেরত পেতে আমরা জোন কমাণ্ডারের সাথে দেখা করতে এসেছি।
তখন টু-আইসি তাদেরকে বলেন, ‘জব্দকৃত সব টাকা সরকারি কোষাগারে চলে গেছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াতে ইতিমধ্যে প্রচারিত হয়েছে। আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও সবকিছু অবগত হয়েছে। সুতরাং এসব টাকা ফেরত দেয়া যাবে না। তারপরও আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে পরবর্তীতে আপনাদেরকে জানানো হবে”— এই বলে প্রতিনিধি দলকে বিদায় দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রতিনিয়ত সাধারণ গ্রামবাসীর বাড়ি তল্লাশি ও টাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র লুটে নেয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব জিনিসপত্র লুটে নেয়ার পরপরই সেনারা বিভিন্ন মিডিয়ায় মিথ্যাভাবে “ইউপিডএফের আস্তানায় অভিযান’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। সেনাবাহিনীর এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেদের প্রমোশন লাভ এবং ন্যায্য দাবিতে পাহাড়ে যে আন্দোলন চলছে তা দমন করা।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।