বান্দরবানের থানছির দুর্গম অঞ্চলে চরম খাদ্য সংকটে পাহাড়িরা

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক: বান্দরবানের থানছি উপজেলার দুর্গম অঞ্চলের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন পাহাড়িরা। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিগত বছরে পাহাড়ে চাষকৃত জুমের ফসল ঘরে তুলতে না পারায় এবছর মার্চ মাস থেকে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, থানছি উপজেলার রেমাক্রি এবং তিন্দু ইউনিয়নের দুর্গম যোগীচন্দ্র পাড়া, বড়মদক ভেতরপাড়া, হৈয়োক খুমী পাড়াসহ আশপাশের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে ৮শ পাহাড়ি পরিবারের প্রায় আড়াই হাজার মানুষ চরম খাদ্য সঙ্কটে রয়েছেন।
গ্রামগুলোতে বসবাসরত পাহাড়িদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে জুম চাষ। আদিকাল থেকে তারা তারা সারা বছরের ধানসহ অন্যান্য ফসল সংগ্রহে রেখে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন’ গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জুমের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি তারা।
হৈয়োক খুমীপাড়া কারকারি (গ্রাম প্রধান) হৈয়ুক খুমি জানান, তার পাড়ায় বসবাসরত ২৭টি পরিবারের মধ্যে কারো ঘরেই একমুঠো খাবারের চাল নেই। প্রতিটি পরিবারেই চরম খাদ্য সঙ্কট। প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের চোখে মুখে এখন ক্ষুধার জ্বালা। অনেক পরিবার আছে, যারা কলা গাছের বোলি (ভেতরের সাদা অংশ) খেয়ে বেঁচে আছেন।
যোগীচন্দ্র পাড়ার বাসিন্দা হাতিরাম ত্রিপুরা জানান, ‘খাবার মজুদ না থাকায় পরিবারের ছয়জন সদস্য তিনদিন ধরে না খেয়ে ছিলেন। চতুর্থ দিনে বিজিবির নির্মাণাধীন একটি ক্যাম্পে কাজ করে ১০ কেজি চাল পেয়েছেন। সেগুলো দিয়ে কয়েকদিন ধরে পরিবারের খাবার চলছে। শেষ হলে আবার কী খাবো, সেটি জানি না।’
বড়মদক ভেতর পাড়ার বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ ক্যমং উ মারমা ও ষাটোর্ধো স্ত্রী মাম্যাচিং জানান, তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনের সঙ্গে মেয়ের ঘরের দুই নাতনিও রয়েছে পরিবারে। ঘরে খাবারের চাল না থাকায় স্ত্রী মাম্যাচিং জঙ্গলে গিয়ে পাহাড়ি আলু সংগ্রহ করে এনেছেন। সেগুলো সিদ্ধ করে খেয়ে কোনো রকম প্রাণে বেঁচে আছেন তারা।
রেমাক্রি ইউনিয়নের ওর্য়াড মেম্বার মাংচং ম্রো বলেন, ‘সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকাগুলোতে কয়েকটি পাহাড়ি গ্রাম রয়েছে। পাড়াগুলোর বাসিন্দাদের কারোর কাছেই খাবারের চাল মজুদ নেই। জুমের ধান শেষ হয়ে যাওয়ায় পাড়াগুলোতে খাদ্য সঙ্কট চলছে। পাহাড়িরা ভাত খেতে না পেয়ে হিংস্র্র হয়ে উঠছে।’
রেমাক্রি ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মুই সৈ থুই মারমা রনি জানান, রেমাক্রী ইউনিয়নে ৯৫ শতাংশ মানুষই জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। গত বছর জুমধান ভালো না হওয়ায় খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পরিবার। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে বাজারজাত করার সুযোগ না থাকায় বাগানের ফল গাছেই পচে নষ্ট যায়। জুমের ধান হলে মুখে হাসি থাকে পাহাড়িদের। আর জুম চাষে ধানের ফলন না হলে দুর্ভিক্ষের ছাপ লেগে থাকে সকলের চোখে মুখে।’
এ জনপ্রতিনিধির দাবি, আগামী বর্ষায় তিনমাস সারাদেশের সঙ্গে দুর্গম অর্ধশতাধিক গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে। তখন এ খাদ্য সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। সেকারণে সঙ্কট নিরসনে দ্রুত সরকারি ও বেসরকারিভাবে খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।’
তিন্দু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মংপ্রু অং মারমা জানান, ‘তিন্দু ইউনিয়নের যোগাযোগবিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোতে প্রায় ৬-৭শ পরিবার এখন খাদ্য সঙ্কটে। এ সরকারের আমলে নানামুখী উন্নয়ন হলেও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গম অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়িদের আর্থ-সামাজিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। দ্রুত খাদ্য না পেলে না খেয়ে মানুষ মারা যাবার আশঙ্কা রয়েছে।’
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানানোর পর জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গত ৮শ পরিবারের জন্য ১৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বরাদ্দকৃত খাদ্য চাহিদার তুলনায় খুবই কম বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক জানান, ‘উপজেলার দুর্গম এলাকাগুলোতে ১৬ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ৮শ পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। নদীতে পানি না থাকায় খাদ্য পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়েছে। তবে গত কদিনের বৃষ্টিতে নদীর পানি স্বাভাবিক হওয়ায় সঙ্কটাপন্ন গ্রামগুলোতে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া ফের শুরু হচ্ছে।’
তিনি জানান, ‘সঙ্কট মোকাবেলার জন্য সরকারিভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যশস্য রয়েছে। তবে এই খাদ্য সঙ্কট যেহেতু আনুমানিক অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে, তাই বিষয়টি সরকারের উর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়েছে। যাতে ভিজিএফ’র মাধ্যমে ব্যবস্থা করা যায়।’
তথ্য ও ছবি সৌজন্যে: সুপ্রভাত বাংলাদেশ।
————————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।