রাঙামাটির ঘাগড়া মোনপাড়ায় আটক তিন গ্রামবাসীকে এখনো থানায় হস্তান্তর করা হয়নি

আটক তিন গ্রামবাসীকে নির্যাতনের চিত্র
কাউখালী প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
রাঙামাটির কাউখালী উপজেলাধীন ঘাগড়া ইউনিয়নের মোনপাড়া থেকে সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক পিতা-পুত্রসহ তিন গ্রামবাসীকে এখনো থানায় হস্তান্তর করা হয়নি বলে জানা গেছে। তাদেরকে কোথায় রাখা হয়েছে সে ব্যাপারেও জানা যাচ্ছে না। পরিবারের লোকজনকেও এ নিয়ে কোন কিছুই বলা হচ্ছে না। ফলে পরিবারের লোকজন গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন।
আটক গ্রামবাসীরা হলেন- মনসুখ চাকমা (৫০), পিতা মৃত বিন্দু কুমার, তার ছেলে সিন্ধু মনি চাকমা (২৩) এবং ৩. অন্তর চাকমা (১৯) পিতা- সোনামুনি চাকমা।
গতকাল মঙ্গলবার (২৪ জুন ২০২৫) ভোররাত ৪টর সময় সেনাবাহিনী ও জেএসএস সন্তু গ্রুপ মিলিতভাবে ঘাগড়ার কজইছড়ি মোন এলাকায় এক সামরিক অভিযান চালায়। এ সময় এলাকার জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে তারা মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করে। তাদের ছোঁড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন ডানে উল্লো গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী এক গ্রামবাসী।
এরপর সেনারা পিতা-পুত্রসহ উক্ত তিন নিরীহ গ্রামবাসীকে আটক করে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে স্থানীয় স্কুল ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ওপর সেনারা অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায়।
পরে সেনারা সেখানে ‘অস্ত্র-গুলি উদ্ধার’ নাটক মঞ্চস্থ করে। তারা প্রথমে কাদামাখা একটি অস্ত্র (এসএমজি বলে তারা পরিচয় দিয়েছে) ও বেশকিছু গুলি উদ্ধার দেখায়। পরে তাদের উদ্ধারকৃত অস্ত্রটির ছবি প্রকাশ হলে নাটকের আসল রহস্য ধরা পড়ে। কারণ তারা যে সময় সেখানে অভিযান ও নাটক মঞ্চস্থ করেছিল সে সময় সেখানে ঝড়-বৃষ্টি হয়নি। কাজেই যেভাবে কাদামাখা অবস্থায় অস্ত্রটি উদ্ধারের ছবি তারা প্রকাশ করে সেটি কারোর কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে নানা প্রশ্ন তোলেন। এরপর তারা আবার সেটিকে পরিষ্কার করে আরেকটি ছবি মিডিয়ায় সরবরাহ করে, যেটিতে আটক তিন গ্রামবাসীকে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল। অস্ত্র ছাড়াও সেনারা গ্রামবাসীদের বাড়ির বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত দা, হাঁড়ি-পাতিলও উদ্ধার দেখায়। এতে তাদের ‘অস্ত্র উদ্ধার’ নাটকটি হাস্যরসের জন্ম দেয়।
তবে, সেনাবাহিনীর সরবরাহকৃত মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন মিডিয়া সত্যতা যাচাই ছাড়াই রাঙামাটিতে সেনা অভিযানে অস্ত্র উদ্ধার ও তিন সন্ত্রাসী আটক– এ ধরনের চটকদার শিরোনাম দিয়ে খবর প্রকাশ করে। আটককৃতরা যে সাধারণ গ্রামবাসী মিডিয়া সেটা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। চিরাচরিত নিয়মে তারা সেনাবাহিনীর দেয়া মিথ্যা তথ্যে নিরীহ গ্রামবাসীদের “সন্ত্রাসী” হিসেবে তুলে ধরে। আর এতে মিডিয়ার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায় যে, সেনারা যে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার দেখিয়েছে সেটা সম্পূর্ণ ভূয়া। নিজেদের আনা অস্ত্র উদ্ধার দেখিয়ে তারা নিরীহ গ্রামবাসীদের ফাঁসিয়েছে। যা অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য।
এ বিষয়ে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, জেএসএস সন্তু গ্রুপ ওই অস্ত্র ও গুলি সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করেছে। শুধু তাই নয়, তারা সরাসরি সেনাবাহিনীর সাথে অভিযানে অংশ নিয়েছে। এসবের বিনিময়ে তারা (সন্তু গ্রুপ) ফুরমোন এলাকাটি দখল নিতে চায় বলে সূত্রটি জানায়।
এদিকে, অস্ত্র উদ্ধার নাটক সাজিয়ে তিন গ্রামবাসীকে নির্যাতন ও আটকের ঘটনায় এলাাকর জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয় মোনপাড়া বাসিন্দাদের অনেকে এখন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা ভয়ে গ্রামে যেতে ও পরিবারের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। গ্রামে যে সকল নারী-শিশুরা রয়েছেন তাদেরকেও স্বাভাবিক চলাচলে বাধাসৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আজ (২৫ জুন) সকালে গ্রামের কয়েকজন নারী তাদের পালিত গরুগুলোকে বাঁধা অবস্থা থেকে ছেড়ে দিতে গেলে সেনারা তাদেরকে বাধা দেয়। নারীরা এর প্রতিবাদ করলে সেনারা এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে তাদেরকে ভয় দেখায় বলে জানা গেছে।
বর্তমানে বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য মোনপাড়া স্কুল ও আশেপাশে এলাকায় অবস্থান করছে। তারা আকাশে ড্রোন উড়াচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে ঘাগড়া এলাকার এক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাহাড়ে সেনা অভিযানের নামে এভাবে সাধারণ জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে তাদেরকে ধরুক, কিন্তু নিরীহ গ্রামবাসীদের কেন ‘সন্ত্রাসী’ সাজিয়ে নিপীড়ন করা হবে?
আরেক মুরুব্বী বলেন, সেনাবাহিনী এভাবে মিথ্যা নাটক সাজিয়ে পাহাড়িদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। গতকাল মোনপাড়ায় বাবা-ছেলেসহ যে তিনজনকে আটক ও নির্যাতন করা হয়েছে তারা সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা। জুমচাষ করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তারা কোনভাবেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত নয়। কিন্তু সেনাবাহিনী সেখানে গিয়ে ‘গোলাগুলি ও অস্ত্র উদ্ধার’ নাটক সাজিয়ে তিন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্যাতন ও আটক করেছে। সেনাবাহিনীর মতো একটি রাষ্ট্রীয় পেশাদার বাহিনী থেকে আমরা এমনটা আশা করি না। সাধারণ জনগণের ওপর এমন নিপীড়ন মেনে নেয়া যায় না।
এলাকাবাসীর অনেকে জেএসএস সন্তু গ্রুপকে ফুরমোন এলাকায় নিয়ে এসে কাউখালী উপজেলায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সেনাবাহিনী এ ধরনের অন্যায় কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন।
এদিকে, চব্বিশ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও আটক তিন গ্রামবাসীকে এখনো থানায় হস্তান্তর করা হয়নি বলে জানা গেছে। তাদেরকে কোথায় রাখা হয়েছে সে বিষয়ে পরিবারের লোকজনকে কোন কিছুই বলা হচ্ছে না। যদিও আটক ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থিত করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
পরিবারের লোকজন সেনাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারছেন না। ফলে আটককৃতদের নিয়ে পরিবারের লোকজন ও স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
এলাকাবাসী ও পরিবারের লোকজন অবিলম্বে আটককৃতদের বিষয়ে সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা এবং তাদেরকে বিনাশর্তে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।