লামায় ম্রো পাড়ায় হামলা, অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা দায়ের, আসামিরা গ্রেফতার হয়নি এখনো
বান্দরবান প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ৮ জানুয়ারি ২০২৩

বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে রেংয়েন ম্রো পাড়ায় হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় অবশেষে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে আসামীদের কাউকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি।
গতকাল শনিবার (৭ জানুয়ারি ২০২৩) পাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) রেংয়েন ম্রো বাদী হয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখপূর্বক আরো ১৫০ থেকে ১৭০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে লামা থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় হামলার নির্দেশদাতা হিসেবে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামে কোম্পানির চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন ও প্রকল্প পরিচালক কামাল উদ্দিন, কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম ও ব্যবস্থাপক আরিফুল ইসলামকে এবং হামলায় নেতৃত্বদানকারী হিসেবে কেয়াজুপাড়া বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. নুরু, লাম্বাখোলা ফজর আলীপাড়ার দেলোয়ার হোসেন, কেয়াজুমাঝেরপাড়ার দুর্যোধন ত্রিপুরা, হাজিরাম ত্রিপুরা, কেয়াজুপাড়ার এলাকার আবদুল মালেক ও মোহাম্মদ মহসিন-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আরো ১৫০ থেকে ১৭০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করে বলা হয়, ১ জানুয়ারি গভীর রাতে ১৫০ থেকে ১৭০ জন লাঠিসোঁটা নিয়ে ছয়টি ছোট ট্রাকে করে রেংয়েন ম্রোপাড়ায় গিয়ে হামলা চালায়। হামলাকারীরা ট্রাকে করে ধারালো অস্ত্র ও কেরোসিন ট্যাংক নিয়ে যায়। হামলা থেকে পাড়াবাসী বনে-জঙ্গলে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। হামলাকারীরা চামরুম ম্রো, রেংওয়ই ম্রো ও সিংচ্যং ম্রোর বাড়ির চলার ঢেউটিন খুলে নিয়ে বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। এতে তিনটি বাড়িতে থাকা মূল্যবান কাগজপত্র (জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ), ১৮ হাজার ২০০ টাকা ও বিভিন্ন গৃহসামগ্রী পাওয়া যায়নি। আরও পাঁচটি বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়েছে। ওই পাঁচটি বাড়ির সৌরবিদ্যুতের প্যানেল, আসবাবপত্র, কাপড়, কৃষিজ সরঞ্জামসহ প্রায় আট লাখ টাকার মালামাল লুট করা হয়।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আসামিদের কাউকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি বলে জানা গেছে।
ঘটনার পরপরই মামলা না দেয়ার কারণ হিসেবে পাড়ার কারবারি রেংয়েন ম্রো বলেন, ’আমরা জানতে পেরেছি কোম্পানির লোকজন পাড়ার আশেপাশে রাবার বাগানে লুকিয়ে আমাদের নজরদারি করছে। তাদের ভয়ে থানায় গিয়ে মামলা করতে ভয় পাচ্ছিলাম। গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি দল ঘটনা তদন্তে আসেন। তাদের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে থানায় গিয়ে মামলা করেছি’।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের পাড়ায় এর আগেও অনেকবার এমন ঘটনা ঘটেছে। আমাদের জুমের বাগান আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে, বৌদ্ধ মন্দির ভেঙে দিয়েছে, কলাগাছ কেটে দিয়েছে, আমাদের খাবার পানির ঝিড়িতে বিষ দিয়েছে, তখনো থানায় অভিযোগ করেছিলাম। কোনো কাজ হয় নাই। অভিযোগ দিয়ে আসার পর আমরা বাজারে পর্যন্ত যেতে পারি না, কোম্পানি লোকেরা দেখলে মারধর করে।’
তিনি হামলার পর থেকে আতঙ্কে থাকার কথা জানিয়ে বলেন, ’দিনে ও রাতে পালা করে পাড়া পাহারা দিচ্ছি। ভয়ে বাইরে কোথাও কাজে যেতে পারছি না। হামলাকারীরা কম্বল, কাপড় নিয়ে যাওয়ায় এতদিন ধরে আগুন জ্বালিয়ে শীতের রাত কাটাচ্ছি’।
উল্লেখ্য, গত বছরের এপ্রিল থেকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লামা উপজেলার সরইয়ে ম্রো ও ত্রিপুরাদের ৪০০ একর জুমভূমি জবদখল করে তাদেরকে উচ্ছেদের অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। গত বছর ৯ এপ্রিল কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন শতাধিক বহিরাগত বাঙালি ও রোহিঙ্গা শ্রমিক নিয়ে এসে ম্রো-ত্রিপুরাদের জুমভূমিতে জঙ্গল কেটে সাফ করে এবং ২৬ এপ্রিল তাত আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ম্রো-ত্রিপুরাদের জুমভূমি, ফসল, বাগান-বাগিচা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর পরই গোটা বছর জুড়ে ম্রো-ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা, বাগান কেটে দেওয়া, মন্দির ভাঙচুর, খাবার পানির উৎসে বিষ প্রয়োগ, ফসল লুটসহ নানা উৎপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানির এই আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং জেলা পরিষদের তদন্ত দল কর্তৃক রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের জমির লিজ বাতিলের সুপারিশ করা হলেও প্রশাসন রাবার কোম্পানি দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
যার ফলে রাবার কোম্পানি কর্তৃক পূনরায় গত ১ জানুয়ারি ২০২৩ দিবাগত গভীর রাতে রেংয়েন ম্রো পাড়ায় হামলা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘ্টনা সংঘটিত হয়েছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন