শহীদ জুনান-রুবেল-ধনরঞ্জন-অনিকের খুনিদের গ্রেফতার ও ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের দাবিতে দীঘিনালায় বিক্ষোভ সমাবেশ

দীঘিনালা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে গত বছর ১৯-২০ সেপ্টেম্বর সেনা-সেটলারের নারকীয় হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, তান্ডবলীলার রিপোর্ট প্রকাশ, জুনান-রুবেল-ধন রঞ্জন ও অনিকের খুনীদের গ্রেফতার এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবিতে দীঘিনালায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদ, দীঘিনালা শাখা।
আজ শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সকাল ১০টায় বিক্ষোভে অংশ নিতে এলাকার ছাত্র-ছাত্রী ও নারী-পুরুষ উদোলবাগান উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এসে সমবেত হন। এরপর সেখান বিভিন্ন শ্লোগানে মিছিল নিয়ে শহীদ ধন রঞ্জন চাকমা বাড়ির পাশের চৌরাস্তায় গিয়ে অস্থায়ীভাবে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীসহ সর্বস্তরের জনগণ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এরপর আবার মিছিল নিয়ে বাঘাইছড়ি দোর সংলগ্ন রাস্তায় ব্রীজে এসে মিছিলটি শেষ হয় এবং সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।



সমাবেশে কলেজ ছাত্র রিটন চাকমার সভাপতিত্ব ও ১০ম শ্রেণির ছাত্রী সুইটি চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন দীঘিনালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা, বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গগন বিকাশ চাকমা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আনন্দ মোহন চাকমা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দীপু লাক্ষ চাকমা, দীঘিনালা উপজেলা নারী সংঘের সভাপতি মিতালি চাকমা ও ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী আদর্শী চাকমা।

চন্দ্র রঞ্জন বলেন, অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সবাইকে রাজপথে নামতে হবে। গত বছর আজকের এই দিনে শাসকদের পাহারায় সেটলাররা পাহাড়িদের উপর হামলা করে। শত শত দোকানপাট পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। সেদিন উদোল বাগানের বাসিন্দা ধন রঞ্জন চাকমা বৃদ্ধ বয়সেও রাজপথে অধিকারের কথা বলতে গেলে সেনাবাহিনীর নির্যতনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আর সবাই কমবেশি জানেন যে, রাঙামাটিতে সেটলাার বাঙালিরা কী নির্মমভাবে অনিক চাকমাকে হত্যা করেছিল এবং খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর গুলিতে কীভাবে জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরা মারা গিয়েছিল।
তিনি অবিলম্বে ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে ধন রঞ্জন, জুনান, রুবেল ও অনিকের হত্যায় জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানান।
গগন বিকাশ চাকমা বলেন, লড়াই সংগ্রামে বৃদ্ধ বয়সের ভরদ্বাজ মনি ঘরে থাকতে পারেননি। একইভাবে ধন রঞ্জনও জাতির মুক্তির পথে এগিয়ে গিয়ে শহীদ হয়েছেন।
তিনি বলেন, অস্তিত্ব টিকে রাখতে হলে সকল জাতিসত্তার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে।
তিনি গত বছর ১৯-২০ সেপ্টেম্বরের নৃশংস হামলায় ধন রঞ্জন, জুনান, রুবেল ও অনিক হত্যার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।

আনন্দ মোহন চাকমা বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, পাহাড়ের বুকে আরেকটি ১৯-২০ সেপ্টেম্বরের হত্যাযজ্ঞ-তান্ডলীলা দেখতে আমরা প্রস্তুত নই। আমরা আমাদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি চাই। আমরা চাই শান্তি, ন্যায় বিচার, ন্যায্য অধিকার এবং দেশের নাগরিক হিসেবে মর্যাদার সাথে বাঁচার নিশ্চয়তা। আমাদের সংগ্রাম কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়, এটি আমাদের জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মান-স্বীকৃতি ও অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। সভ্য দুনিয়ায় মানুষ হিসেবে মানবাধিকার লাভের লড়াই।
দীপুলাক্ষ চাকমা বলেন, অন্যায়-অবিচার দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের এই আন্দোলন চলবে, চলতেই থাকবে। কারণ ইতিহাস সাক্ষী— জনগণের ন্যায্য সংগ্রাম কখনও দমিয়ে রাখা যায় না। সত্যকে কখনোই মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। আমাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ করা যাবে না। হুমকি দিয়ে ষড়যন্ত্র করে আজ আমাদের থামানো যায়নি, ভবিষ্যতেও থামানো যাবে না।
তিনি বলেন, আমরা সমস্ত রক্তচক্ষু-হুমকি উপেক্ষা করে আজ এখানে দাঁড়িয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছি, অধিকারের লক্ষ্যে আওয়াজ তুলছি।
তিনি গত বছর হামলা চালিয়ে ধন রঞ্জনদের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদানের দাবি জানান।

আদর্শি চাকমা গতবছর সংঘটিত বর্বরোচিত ঘটনার কথা তুলে ধরে বলেন, এক বছর পেরিয়ে গেলেও আজও এ নারকীয় তাণ্ডবলীলার তদন্ত রিপোর্ট ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রকাশ করেনি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ন্যূনতম ক্ষতিপূরণও পায়নি। ড. ইউনুসের কর্তব্য ছিল ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো, দোষীদের বিচারের আওতায় আনা, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, তার উল্টোটা ঘটেছে। আজও যখন আমরা ন্যায়বিচারের দাবিতে আওয়াজ তুলছি, তখন আমাদের আবারো হুমকি দেওয়া হচ্ছে, দমন-পীড়নের শিকার হতে হচ্ছে।
তিনি অবিলম্বে এই ঘটনার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত, দোষীদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান।

সমাবেশের সভাপতি রিটন চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, গত বছরের এই দিনে দিঘীনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে আমাদের জনগণের ওপর পরিকল্পিতভাবে সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিরা মিলে হামলা চালিয়েছিল। খাগড়াছড়িতে সেনারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরাকে হত্যা এবং পঞ্চাশ জনের অধিক লোককে গুরুতর জখম করে। দীঘিনালায় ধনঞ্জয় চাকমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে হত্যা করে ঠাণ্ডা মাথায়। পরের দিন রাঙ্গামাটিতে পুলিশের উপস্থিতিতে সেটলাররা অনীক চাকমাকে পিটিয়ে খুন করে। তাদের নিক্ষিপ্ত ইট পাটকেলের আঘাতে শতাধিক গুরুতর জখম হয়। দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে দুই শতাধিক নিরীহ পাহাড়িদের ঘরবাড়ি সেটলারদের অগ্নিসংযোগে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারা বেছে বেছে পাহাড়িদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাটে লুটপাট চালায়, এমনকী রাঙামাটির বনরূপায় বৌদ্ধ বিহারও তাদের হামলা থেকে বাদ যায়নি। বিহারের দান বাক্স লুট করে মূল্যবান জিনিসপত্রও তছনছ করে দেয়।
এক বছরেও এ হামলার ঘটনার বিচার না হওয়ায় তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এ কোন রাষ্ট্রে আমরা বাস করছি? ২৪-এর জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পরও পাহাড়ে কোন কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে যে দমন-পীড়ন জারি ছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও তাই আছে। আমরা ন্যায়-বিচার পাচ্ছি না। এটা ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি অতি দ্রুত গত বছরের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর সংঘটিত হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।