তারা বলে এটা রাষ্ট্রের স্বার্থ, কিন্তু আমরা বলি, এটা হল আমাদের ঝাড়েবংশে নির্মুল করা

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ দিঘীনালার বাবুছড়ায় বিজিবি ৫১ নং ব্যাটালিয়ন দপ্তর স্থাপনের জন্য জুম্ম জনগণের প্রায় ৩০ একর জায়গা জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে। সেখানে তারা গত ২০১৪ সাল থেকে এই দুই বছরে বেশ কয়েকটি বিল্ডিঙ তৈরী করেছে। রাষ্ট্রের সুপার পাওয়ার অথবা পেশীশক্তিকে অন্যায় অন্যায্যভাবে ব্যবহার করে তারা এই দখল ও উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে।
এই বিষয় নিয়ে সিএইচটিনিউজ.কম থেকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ০৩ জুন এই প্রতিবেদক দিঘীনালা এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সাথে এ বিষয়ে আরেকবার কথা বলেন। দিঘীনালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে সন্ধ্যার দিকে তার বাড়ির বারান্দায় আলাপচারিতায় তিনি খুব দুঃখভারাক্রান্ত মনে বলেন, আমাদের বাপদাদার ভিটেমাটিতে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসা জায়গা আমরা সম্ভব আর ফিরে পাবো না। চিরজীবনের জন্য বোধহয় আমরা সেই জায়গাগুলোর নাম নিতে পারব না।
তিনি জানালেন, ২১ পরিবারের জায়গা জমি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তারা আন্দোলনে শামিল হওয়ার পরে তিনিসহ এলাকার প্রায় ২০০ জনের নামে সরকার মামলা করেছে। এই মামলা হবার পরে পুলিশবাহিনী তার বাড়ি প্রায় তিনবার ঘেরাও করেছে। তবে তিনি বাড়িতে না থাকায় গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন।
তিনি জানান, আমরা যারা মামলার শিকার হয়েছি তাদেরকে এখন দিঘীনালা প্রশাসন আর কোথাও আমন্ত্রণ করে না। তারা জনপ্রতিনিধি হয়েও এখন তাদের বিভিন্ন মিটিঙে ডাকা হয় না। একবার বাবুছড়া ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও দিঘীনালা ভুমিরক্ষা কমিটির সভাপতি পরিতোষ চাকমাকে ঈদের দিন দিঘীনালা সেনা প্রশাসন ভুলে আমন্ত্রণ করে ফেলে। তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দিঘীনালা ক্যান্টনমেন্টের গেটে পৌঁছেন। তবে সেখানে গিয়ে ডিজিএফআই-এর এক সদস্য পরিতোষ চেয়ারম্যান/চাকমাকে অতিসত্ত্বর সেখান থেকে চলে যেতে বলেন, তা না হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে তিনি হুশিয়ারি দেন। পরিতোষ চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার এড়াতে তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে সরে পড়েন।
ভুমি বেদখল বিষয়ে মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা তো বলে এই দখল কাজটি তারা রাষ্ট্রের স্বার্থে করে থাকে, কিন্তু আমরা বলি তা হল আমাদেরকে ঝাড়েবংশে নির্মুল করা’ (তারা দ কনদে রাষ্ট্রর স্বার্থত্তেই আমি ইআন গুরি। হালিক আমি দ কোইদেই ইআনি আমারে খুন গুরিবাত্তেই)।
এরপর পরিতোষ চাকমা’র সাথে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করে সিএইচটিনিউজ.কম প্রতিবেদক। পরিতোষ চাকমাও আন্তরিকতার সাথে তার মনের কথা খুলে বলেন। তিনি জানালেন, ২১ পরিবারের লোকজন এখন খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তারা তাদের জায়গাজমি ফিরে পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছে। এখন কোনমতে সরকারের কাছ থেকে পুনর্বাসন পেলেই তাদের জন্য স্বর্গ পাওয়ার মত হয়ে যাবে। তিনি বললেন, আমরা এখনো আশা করছি উচ্চ আদালত আমাদের জুম্ম জনগণের পক্ষে রায় দেবে। তিনি জানালেন, আইনে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জায়গা অধিগ্রহণ করতে হলে অবশ্যই জেলা পরিষদের পূর্বানুমতি নিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে তো আইন নিজস্ব গতিতে চলে না। তিনি প্রশ্নের সুরে বলেন, বিচাররকগণ কি সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিতে সাহস করবেন?
তিনি বিজিবি কর্তৃক জায়গা দখলের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বলেন, ২০০৪/৫ সালের দিকে বিজিবি বর্তমানে তাদের দখল করা জায়গার চারদিকে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছিল। এই জোরপূর্বক দখলের প্রতিবাদে লাল পতাকার ঘেরাওয়ের মধ্যে ১১ জনের রেজিস্ট্রিকৃত জমির মালিক উচ্চ আদালতে একটি মামলা করে। পরে বিজিবি তাদের জায়গা বাদ দিয়ে বাকি প্রায় ৩০ একর জায়গা দখলে নিয়ে নেয়। তিনি বলেন অথচ সে সকল জায়গাও ছিল নানা জনের দখলীস্বত্বাধীন জমি।
তিনি জানালেন, তাদের এলাকার পাহাড়ভুমিতে সাধারণভাবে দখলীস্বত্বের ভিত্তিতে এতদিন ধরে মালিকানা নির্ধারিত হয়ে আসছে। এসময় তিনি বাবুছড়া এলাকার জারুলছড়ি এলাকার কথা উদাহরণ টেনে বলেন, আমাদের গ্রামে প্রায় ১৬০ থেকে ১৭০ পরিবার বসবাস করছে তাদের নিজস্ব পাহাড়ভুমিতে। তাদের মধ্যে ৫ জনের নাম উল্লেখ করে বলেন, এই শত শত একর পাহাড়ভুমিতে বসবাসকারীদের মধ্যে মাত্র এই ৫ জনের পাহাড় রেজিস্ট্রি করা আছে। বাকিরা শুধুমাত্র দখলীস্বত্বের ভিত্তিতে তাদের পাহাড়গুলোর মালিকানা বজায় রেখেছে। ৫ জনের নামে মাত্র ১৮ একর ৮০ ডেসিমেল পাহাড়ভুমি সরকারী রেজিস্ট্রিকৃত।
পরিতোষ চাকমা আরো বললেন, ২০০৪/৫ সালে যে ১১ জন তাদের রেজিস্ট্রিকৃত জমি বেআইনী দখলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তাদের জমিও বর্তমানে বিজিবি’র দখল করা জায়গার ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, এতে বিজিবি তাদের জায়গা কেড়ে না নিলেও পরে নানা টালবাহানা করে তারা এই জায়গা জমির মালিকদের ভোগ করতে দেবে না বলে তিনি জানান। তিনি জানালেন, দেখা যাবে বিজিবি কর্তৃপক্ষ পরে সেখানে সঠিক সময়ে তাদের জমি চাষ করতে বাধা দিচ্ছে। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে সঠিক সময়ে তাদের চাষাবাদকৃত জমির দেখভাল করতে দেবে না। জমির মালিকরা নানা হয়রানীর শিকার হবে।
ফলে পরে এক অর্থে বাধ্য হয়েই তাদের জমি ছেড়ে দিতে হতে পারে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।
এর পর প্রতিবেদক দিঘীনালা উপজেলা চেয়ারম্যান নবকমল চাকমা’র সাথে এ বিষয়ে কথা বলেন। নবকমল চাকমা বললেন, বিভিন্নজনকে সাথে নিয়ে তিনি ২১ পরিবারের জায়গা বিজিবি’র কাছ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। এখন এতে ক্ষান্ত দিয়ে তিনি এখন চেষ্টা করে যাচ্ছেন ২১ পরিবার যেন ন্যুনতম তাদের আশ্রয়টুকু পায়। তিনি জানালেন, ২১ পরিবার বিষয়ে তারা আগামী কয়েকদিরে মধ্যে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন।
শরণার্থী কল্যাণ সমিতি’র এক নেতার সাথে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি জানান, বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদকৃত ২১ পরিবারের মধ্যে প্রায় ১৬টি পরিবার ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সরকারের সাথে ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের মধ্যে যে চুক্তি বা সমঝোতা হয় তাতে শরণার্থীদেরকে তাদের নিজস্ব বাস্তুভিটা ফিরিয়ে দেয়ার কথা রয়েছে। অথচ সরকার বাস্তুভিটা ফিরিয়ে দেয়া তো দূরের কথা বরং দেখা যাচ্ছে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতির ভিত্তিতে শণনার্থীদের নিজস্ব জায়গায় বিজিবি হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি নাম প্রকাশ করা হবে না এই শর্তে বলেন, ২০১৪ সালে বিজিবি ২১ পরিবারকে জায়গা থেকে উচ্ছেদ করার প্রতিবাদে তারা জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতি’র ব্যানারে রাজপথে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দিঘীনালায় সক্রিয় থাকা একটি দলছুট সংগঠনের নেতাকর্মীরা নানাভাবে তাদের রাজপথে নামতে বাধা দিয়েছে। এতে ২১ পরিবারের জমি বেদখলের বিরুদ্ধে নানাভাবে আড়ালে থেকে লড়াই চালিয়ে গেলেও প্রকাশ্যে কোন ধরনের কর্মসূচি তারা নিতে পারেননি বলে জানান। তবে আগামীতে তারা দলছুট এই সংগঠনের জুম্ম বিরোধী ভুমিকা মানবেন না বলে তিনি জানান। তিনি তাদের এই ধরনের কর্মকান্ডে ব্যাপক হতাশাও ব্যক্ত করেন।
—————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।