দীঘিনালায় বিজিবির জমি ‘অধিগ্রহণ’: উচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সংখ্যা ২১ নয়, আরো বেশী

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ দীঘিনালায় বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কারণে ২১ পরিবার পাহাড়ি উচ্ছেদের শিকার হয় বলে দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তার সংখ্যা অনেক বেশী।
এ প্রতিবেদক উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে জানতে পারেন বিজিবি যেখানে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর নির্মাণ করছে সেখানে আগে শশী মোহন কার্বারী পাড়া ও যত্ন কুমার কার্বারী পাড়া নামে দুটি গ্রাম ছিল এবং এই দুই গ্রামে মোট ৫০ থেকে ৬০টি বাড়ি ছিল। এটা ১৯৮৩ – ৮৪ সালের দিকের কথা।
এক সময় ব্যাপক সেনা নির্যাতনের কারণে এই দুই গ্রামের লোকজন ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ১২ বছর শরণার্থী জীবন শেষে ফিরে এলেও তারা আর্মিদের বাধার নিজ গ্রামে গিয়ে ঘর তুলতে পারেন নি। সেই পর থেকে তারা অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অর্থাৎ বিজিবি ব্যাটালিয়নের জন্য জমি অধিগ্রহণের বহু আগেই তারা উচ্ছেদের শিকার হন।
উচ্ছেদ হওয়ার আগে উক্ত দুই গ্রামের জন্য একটি বৌদ্ধ বিহারও ছিল। ওই বিহারটি পুনঃ নির্মাণের জন্য বার বার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাবুছড়া ক্যাম্পের সেনাদের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এছাড়া গ্রামের পাশে একটি শ্মশানও ছিল, তাও বিজিবি অধিগ্রহণের নামে জোরপূর্বক দখল করে।
এক সময় যত্ন কুমার কার্বারী পাড়ার বাসিন্দা ও বর্তমানে বিজিবি যেখানে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর নির্মাণ করছে তার দক্ষিণ দিকে অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন জগদীশ চাকমা। তিনি অন্য জনের ঘর তৈরি করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, ‘বিজিবি প্রায় ২৯ একর ৩১ ডেসিমেল জায়গা দখলে নিয়েছে। আজ যেখানে বিজিবি অবৈধভাবে তাদের বিল্ডিঙ তুলছে সেখানে ১৯৮৩-৮৪ সালের আগে ’ভরন্দি আদাম’ (লোকে লোকারণ্য গ্রাম) ছিলো। সেখানে প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি বাড়ি ছিল।’
তাদের বর্তমান ভিটেবাড়ি থেকে উত্তরে বিজিবির তৈরী করা বহুতলা বিল্ডিংগুলো দেখিয়ে তিনি বললেন, তাদের পিতা মাতা ও আত্মীয় স্বজন পরিবার নিয়ে সেখানে বসবাস করতো। তার স্ত্রী জানালেন, তাদের মা বাবারা পাহাড়ের নিচে কুয়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতেন। তাদের মতে ‘বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণ একটি উছিলা মাত্র, আসল উদ্দেশ্য আমাদের জমি কেড়ে নেয়া।’
জগদীশ চাকমা দিঘীনালা মৌজা হেডম্যানের সই করা একটি কাগজ দেখিয়ে বললেন, তাদের সেখানে ২৫ ডেসিমেল-এর মত জায়গা বন্দোবস্তি রয়েছে। তিনি জানালেন, তাদের পিতা ধনঞ্জয় চাকমার জায়গার পাশে মনোরঞ্জন চাকমা নামে অন্য একজনের প্রায় এক একর মতো জায়গা বন্দোবস্তি করা ছিল। সেনাবাহিনীর পেরেশানি বা তুচ্যায় ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে উক্ত জায়গা থেকে উচ্ছেদ হবার পরে তিনি ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হন। তারপরে সেখান থেকে ফিরে আসার পর তার জমি ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বার বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হবার পরে এখন সাজেকের দুর্গম লক্ষীছড়িতে ফার্মেসি খুলে হাতুড়ে ডাক্তারি করে সংসার চালাচ্ছেন।
তিনি আরো জানালেন, ফরিয়া (চন্দক বাপ) নামে এক ব্যক্তির জায়গায় বিজিবি এখন একতলা একটি বিল্ডিং তুলেছে। তিনি ভিক্ষু অবস্থায় ৪/৫ বছর আগে মারা যান। তার পুত্র চন্দকও এখন ভিক্ষু হয়ে দিন যাপন করছেন। তিনি আরো জানালেন এভাবে তাদের পিতামাতার পুরাতন গ্রামের আরো অনেকেই তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম জায়গায় বসত করতে বাধ্য হয়েছেন।
ভিটেমাটি হারানো ২১ পরিবারের লিস্টে তারা আছেন কি না প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, তাদের নাম সেখানে নেই। এভাবে সেই পুরাতন ৫০/৬০ পরিবারের আরো অনেকের নামই উক্ত লিস্টে নেই বলে তিনি জানালেন।
জগদীশের সাথে ছিলেন কালিমোহন চাকমা (পিতাঃ মৃত কল্পতরু চাকমা)। তিনিও বললেন, বিজিবি এখন যেখানে বিল্ডিঙ করেছে সেখানে একসময় তাদের ঘরবাড়ি ছিল।
জগদীশ ও কালিমোহন এখন অন্যের জমিতে বসবাস করছেন। তারা তাদের বর্তমান বসতভিটা দেখিয়ে আশংকা প্রকাশ করে বললেন, আমাদের এই ভিটেমাটি ঘরবাড়িতেও আমরা কতদিন থাকতে পারবো জানি না। কখন যে তারা (বিজিবি) জোর করে আমাদের জায়গা দখল করে তা হয়তো আমরা জানতে পারবো না। ভারতে শরণার্থী ছিলাম, এখানে এসেও শরণার্থীর মতো জীবন যাপন করতে হচ্ছে। নিজ দেশে পরবাসীর জীবন আর কতদিন কাটাতে হবে তা ভগবানই জানেন। এই বলে জগদীশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজ কাজে চলে গেলেন।
——————
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।