পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈ-সা-বি নিয়ে কিছু ভাবনা
অমল ত্রিপুরা
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বি শেষ হলো। এ উৎসবের আমেজ হয়তো আরো দুয়েকদিন থাকতে পারে। কিন্তু এই উৎসবকে পর্যালোচনা করলে প্রকৃতপক্ষে উৎসবকে ঘিরে পাহাড়িরা কী সংস্কৃতি চর্চা করছে বা করতে চাচ্ছে তা বোঝা দুস্কর।
গ্রামীণ সমাজে বেড়ে উঠেছি বলে ছোটকাল থেকে দেখে আসছি বৈ-সা-বি’তে আমাদের মা-বাবা, গ্রামের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা কিভাবে উৎসবমূখর পরিবেশে বৈ-সা-বি উৎসব পালন করতেন। আমরা দেখতে পেতাম বৈ-সা-বি ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তাঁরা সকলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সকল কাজের প্রস্তুতি নিয়ে তা ধীরে ধীরে সম্পন্ন করে রাখতেন। বৈ-সা-বি আসলে নিজস্ব রীতি-নীতি চর্চা করতেন। যেমন নদী কিংবা ছড়ায় ফুল দিয়ে পূজা করা, শোভাযাত্রা, নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরিধান ও ফুল দিয়ে মালা গেঁথে বাড়ি-ঘর সাঁজানো, সকাল-সন্ধ্যা ধুপ-বাতি দিয়ে আলো জ্বালানো, বাড়ির জ্যেষ্ঠদের গোসল করানো, বাড়িতে থাকা গৃহপালিত পশু-পাখিদের সেবা-যত্ন নেওয়া-তাঁদের গলায় এক ধরণের ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া, কিশোর-কিশোরীরা, তরুণ-তরুণীরা সকাল সকাল স্নান করে পাড়ার প্রতিবেশীদের বাড়িতে উঠোনে উঠোনে গিয়ে ধান ছিটিয়ে দেওয়া, নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা আয়োজন করা (ব্যতিক্রম কিছুও রয়েছে), নিজেদের হাতে তৈরি পিঠা ও অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা ইত্যাদি। কোন একটি নাম দিয়ে এসব আয়োজন করা হত গ্রামের মুরুব্বী, যুব-তরুণ সমাজ কিংবা স্ব-স্ব উদ্যোগে। বড়দের এসব আয়োজন দেখে আমরা অনুপ্রেরণা পেতাম, আনন্দ, বিনোদন উপভোগ করতাম, উৎসবে মেতে উঠতাম। এসবের মাধ্যমে গ্রামে অপসংস্কৃতি চর্চা ও সামাজিক অবক্ষয় বিষয়গুলো খুব একটা চোখে পড়তো না। গ্রামের তরুণ সমাজ তা সহজে গ্রহণ করতেন না। আমাদের বাবা-মা, বড় ভাই-বোনরাও তা করতেন না। একটা ভালো পরিবেশেই বৈ-সা-বি বরণ ও বিদায় জানাতেন।
কিন্তু বর্তমানে সে চিত্র ব্যতিক্রম। কয়েকটি স্থান ব্যতিত তেমনটা চোখে পড়ে না। এমনকি নিজের গ্রামেও এমন আর দেখা যায় না। সবই এখন উল্টো দিকে চলছে। পাহাড়িদের সমাজ ব্যবস্থা আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে যা ছিল তাও ধীরে ধীরে ভাঙতে ভাঙতে প্রায়ই ভেঙে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। আমাদের সমাজে ঢুকে পড়েছে ‘সামাজিক’ নামে তথাকথিত সামাজিক অবক্ষয়ের বস্তুগুলো, আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে চর্চা হচ্ছে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখলে বুঝা যায় আসলে আমরা আগের মতো বৈ-সা-বি পালন করছি না, আনন্দ-উৎসব করছি না। আমাদের তরুণ সমাজ নিজস্ব ঐতিহ্য ভুলে যেতে বসেছে। তারা ঐতিহ্য রক্ষার পরিবর্তে নিজেরাই অপসংস্কৃতি চর্চা করছে, সভ্য সমাজ তথা পাহাড়ি সমাজে যেটা চর্চা হত না তা নিয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠছে। প্রজন্মকে এমনভাবে শেখাচ্ছে যে এটাই সঠিক, এটাই বৈ-সা-বি’র আসল রূপ। একটি সমাজের তরুণেরা যদি এপথে ধাবিত হয় তাহলে নিশ্চয় বলতে হবে এটি পাহাড়ি জাতির জন্য শুভকর নয়, পরাধীন জাতি হিসেবে এটি আগামীর জন্য অশনি সংকেতও বটেই। বর্তমান যুব-তরুণ সমাজের অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে সমাজকে রক্ষা করবে কে???
অপরদিকে আমাদের সমাজের প্রতিনিধিত্বকারীরা কিংবা আমাদের অভিভাবকরা প্রজন্মকে কী শেখাচ্ছে তা বিস্তারিত লেখার প্রয়োজনীয়তা আমি মনে করছি না। তবে এটাই বলবো পাহাড়ে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়া বা সমাজ অবক্ষয়ের দিকে যাওয়ার জন্য প্রথমত দায়ী এরাই। প্রজন্মকে নিজের ভবিষ্যত গড়া বা স্বপ্ন দেখার দোহায় দিয়ে এবং নিজ নিজ স্বার্থের কাজে ব্যবহার করে তরুণ সমাজকে বিপথে পরিচালিত করে সুষ্ঠু-সুন্দর সমাজ গঠনের জায়গায় লোভ-লালসা, প্রলোভনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলস্বরূপ বর্তমানে পাহাড়ে দেখতে পাই নতুন প্রজন্ম এখন সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি, অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণহীন, সমাজের অবক্ষয় রোধে তাঁদের কোন ভূমিকা কিংবা মাথা ব্যাথা নেই। গ্রামে গ্রামে চলছে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
এখানে আলোচনা করা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈ-সা-বি পালন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি চর্চা ও একটি সুষ্ঠু-সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ এবং তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা বিষয়ে।
গত ১১ এপ্রিল ২০২৩ বৈ-সা-বি উপলক্ষে খাগড়াছড়ি শহরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও সার্বজনীন বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটির উদ্যোগে পৃথকভাবে দু’টি শোভাযাত্রা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখেছি। একই দিনে একই সময়ে খাগড়াছড়ি শহরে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করা হয়েছে। দু’টি শোভাযাত্রা বৈ-সা-বি উপলক্ষে হলেও অবস্থানগত দিক থেকে তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আমরা লক্ষ্য করেছি জেলা পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত শোভাযাত্রায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, স্থানীয় সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনসহ অন্যান্য ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের শোভাযাত্রায় ব্যান্ডপার্টি দলের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে একটি উৎসবমূখর পরিবেশ। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও চোখে পড়ার মত। শোভাযাত্রা শেষে তারা ডিসপ্লে করেছিলেন। এটি টিভি চ্যানেল, প্রিন্ট মিডিয়াতেও ফলাওভাবে ছাপানো হয়েছিল।
অপরদিকে সার্বজনীন বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটি উদ্যোগে আয়োজিত বৈ-সা-বি শোভাযাত্রাটি খুব সাদামাটা দেখা গেছে। তবে তারা এ শোভাযাত্রার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ফূটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। শোভাযাত্রার সামনে সারিতে থাকা ব্যানার-প্ল্যাকার্ডেও বৈ-সা-বি নিয়ে তাদের ভাবনা, উদ্দেশ্যে, আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছিল। শোভাযাত্রা শেষে কমিটি’র পক্ষ থেকে বৈ-সা-বি উপলক্ষে পার্বত্য অঞ্চলে ৪দিনের সাধারণ ছুটির দাবি জানিয়েছিলেন। কমিটি’র এ দাবি খুবই যুক্তিযুক্ত ও পাহাড়িদের জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং সরকারের পক্ষ থেকে তা বাস্তবায়ন জরুরি।
সার্বজনীন বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটির শোভাযাত্রা শুরু করা হয়েছিল ত্রিপুরাদের কাথারাক নৃত্য বা বোতল নৃত্য দিয়ে, শেষ হয়েছে ময়ূর নৃত্য, গরিয়া নৃত্য, বম, সাঁনতাল নৃত্যসহ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের নিজস্ব নাচ-গান দিয়ে। এটি শহরে অনুষ্ঠিত হলেও এই শোভাযাত্রার খবর দেশের কোন মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি।
লক্ষ্যণীয় যে, সার্বজনীন বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত শোভাযাত্রায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সকলে তরুণ-তরুণী এবং তারা নিজেদের প্রচেষ্টায় পাহাড়ের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ধারাগুলো তুলে ধরেছেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে কাথারাক-গরিয়া নৃত্য, বম-সাঁন্তাল নৃত্য ও চাকমাদের গেঙখুলি গান যারা পরিবেশন করেছিলেন তারা সকলে স্ব উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কোন অর্থের বিনিময় বা ভাড়াটিয়া মনোভাব নিয়ে তারা তা করেননি। তারা নিজেদের চেষ্টায় যতটুকু সম্ভব ততটুকু পরিবেশন করেছেন।
আমি আর বিস্তারিত বর্ণনা বা ব্যাখ্যা না টেনে লেখাটি শেষ করবো। জেলা পরিষদের বৈ-সা-বি শোভাযাত্রায় সরকারের কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ঠিকই, এতে অনেকে আনন্দ উপভোগও করেছেন। কিন্তু সেখানে কোন মাহাত্ম্য নেই। অর্থের বিনিময়ে অনেক কিছু করা যায়, অনেক কিছু দেখানো যায়, রঙ্গ তামাশা করা যেতে পারে, আনন্দ-বিনোদন, উৎসব, উল্লাসে মেতে উঠতে পারবেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ক্ষণিকের জন্য, তার কোন স্থায়ীত্ব নেই।
অপরদিকে, যারা মনে প্রাণে নিজেদের শ্রম দিয়ে নিজস্ব ঐতিহ্য সংস্কৃতি চর্চা করেন, নিজে এবং অন্যদের তা রক্ষার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে থাকেন, আপ্রাণ চেষ্টা চালান এবং জাতি-সমাজের নিকট তা তুলে ধরেন, সর্বোপরি নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে পারলে প্রকৃতপক্ষে এটাই হল স্থায়ীত্ব। আর এ ধারাটিই হবে পাহাড়িদের জন্য মঙ্গল, এটিই হবে নতুন বা তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। এটাই হচ্ছে সকলের স্বার্থকতা এবং ভবিষ্যতে জাতি-সমাজের জন্য ভালো ও আলোর পথ প্রদর্শক।
* লেখক পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন