সাভারে অপহৃত গার্মেন্ট কর্মী আদিত্য চাকমা উদ্ধার, আটক ২
সিএইচটিনিউজ.কম
ঢাকা প্রতিনিধি : অপহৃত গার্মেন্টস কর্মী আদিত্য চাকমা (২৬) পিতা মৃত অমর বিহারী চাকমা, বাঘাইছড়ি, রাঙ্গামাটিকে-কে অপহরণের সাত দিনের মাথায় সাভারে সন্তু গ্রুপের দুর্বৃত্তদের একটি আস্তানা থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল শনিবার(২৭ জুন) দিবাগত রাতে তাকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় অপহরণের প্রধান পরিকল্পনাকারী বিভিন্ন অপরাধের দাগী আসামী ও সন্তুগ্রুপের (জনসংহতি সমিতি)-এর স্থানীয় সন্ত্রাসী গডফাদার হিসেবে পরিচিত দিলীপ চাকমা ও তার এক সহযোগী আসেন্টু চাকমাকে অপহৃতকে প্রহরারত অবস্থায় হাতেনাতে আটক করেছে পুলিশ।
গত ১৯ জুন ২০১৫ রোজ শুক্রবার ঢাকার মিরপুর থেকে আদিত্য চাকমাকে সন্তু লারমার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর গত ২৬ জুন মিরপুর মডেল থানার আদিত্য চাকমার অসুস্থ বৃদ্ধ মা তার ছেলেকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীদের গ্রেফতারের আর্জি জানিয়ে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। একই তারিখের রাতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে দিবাগত রাত ৩.০৫মিনিটে সাভারের আশুলিয়া থানার বুড়িবাজার গাজিরচট এলাকার শাখাওয়াত মিঞার বিল্ডিং (বার্ডস গ্রুফ ফ্যাক্টরীর পাশে এবং পাহাড়িদের কাছে প্রমেশ ফ্লাট হিসেবে পরিচিত) -এর তৃতীয় তলা থেকে তাকে উদ্ধার করে এবং ঘটনাস্থল থেকে অন্যতম প্রধান আসামী দিলীপ চাকমাসহ দু’জনকে আটক করে।
২৭ জুন আদালতে হাজির করে জবানবন্দী নিয়ে আদিত্যকে মুক্তি দিয়ে অপহরণকারী দিলীপ ও আসেন্টুকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, অপহরণের পর দুর্বৃত্তরা আদিত্য চাকমাকে দিয়ে তার বড় বোনের কাছ থেকে প্রথমে ৩ লক্ষ টাকা এবং পরে ২ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ ছাড়া সামাজিকভাবে যোগাযোগ করে ছাড়িয়ে আনার বহু চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু সন্ত্রাসীরা মুক্তিপণ না পেলে তাকে দেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় এবং টাকা দিতে না পারলে তাকে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। উপায়ন্তর না দেখে আদিত্যের অসুস্থ মা গত ২২ জুন তারিখে ঢাকায় চলে আসেন এবং ২৬ জুন তারিখে মিরপুর মডেল থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন।
অপহৃত আদিত্য চাকমা ঘটানার বর্ণনা দিয়ে সিএইচটিনিউজ ডটকমকে বলেন, গত ১৯ জুন ২০১৫ তারিখে ৩জন নিকট আত্মীয় ফায়ায় সার্ভিসে নিয়োগ পরীক্ষা দেয়ার জন্য ১৮ তারিখ সকালে কাঁচপুরে আমার ভাড়া বাসায় ওঠে। পরদিন ফ্যাক্টরী খোলা থাকা সত্ত্বেও তাদের অনুরোধে গাইড হিসেবে ঢাকার মিরপুর ১০-এ ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ে (গোল চত্বরে পাশে) আমাকে যেতে হয়। সকাল ৮টায় ৩জন পরীক্ষার্থী হলে ঢুকার পর আমি বাইরে তাদের অপেক্ষায় থাকি। এসময় প্রাকৃতিক কাজ সারতে অন্য একজন পরিচিত বন্ধুকে সাথে নিয়ে মিরপুর ১৩ নাম্বারে আদিবাসী গ্রীণহার্ট স্কুল এন্ড কলেজে যাই। কাজ সেরে বেড়িয়ে আসার সময় ৬-৭জন লোক সহ একটি মাইক্রোবাস কলেজের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। গেইট থেকে বেড়োনোর সাথে সাথে আমাকে তারা টেনে হেঁচড়ে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। আমি কোন মতে দৌঁড়ে কলেজের কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ি। এসময় কলেজের নিরাপত্তাকর্মীরা গেইট বন্ধ করে দেয়। সাথে সাথে অপহরণকারীদের কয়েকজনও ভেতরে প্রবেশ করে। তারা চিৎকার করে আমার নাম ধরে বলতে থাকে “তুমি বাঁচতে পারবে না, জান এটা আমাদের এলাকা! এখানে থাকলে বাঁচতে পারবে সেটা ভেবো না। তুমি বরং লক্ষী ছেলের মতো গাড়িতে গিয়ে ওঠো। ভালোভাবে গেলে তোমার জীবন রক্ষা পাবে, আর যেতে না চাইলে তোমাকে এখানে মেরে ফেলবো।” এরপর আমি পরিচিতজন কাউকে খুঁজতে থাকি। এমন সময় রাঙ্গামাটির রাজস্থলী থেকে শুভ তঙচঙ্গ্যা নামে এক বন্ধুকে পেয়ে যাই। ছাত্রজীবনে একসাথে রাঙ্গামাটির মৌনঘর স্কুলে পড়ি, সে আমার ক্লাসমেট ছিল, বর্তমানে কুমিল্লায় পড়াশোনা করছে। উপায়ন্তর না দেখে তাকে সাথে নিয়ে অপহরণকারীদের গাড়িতে ওঠে পড়ি। মাইক্রোবাস সাভারের বুড়িবাজার গাজিরচট এলাকায় পৌঁছলে শুভ তঞ্চঙ্গ্যাকে দুর্বৃত্তরা ছেড়ে দেয়। এরপর আমাকে নিজের মোবাইল ফোন থেকে বড় বোন সহ, বন্ধু এবং সমাজের মুরুব্বিদেরকে ফোন করতে বাধ্য করে আর মুক্তিপণ দাবি করে।”
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাভারে পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় বিভাষ চাকমা ও দিলীপ চাকমার নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি অপরাধী চক্র দীর্ঘদিন ধরে মদ বিক্রি, নকল মধু তৈরি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে পত্রিকায় কয়েকবার প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। সাভার উপজেলাধীন আশুলিয়ার থানার অন্তর্গত গাজিরচট, পল্লী বিদ্যুৎ, ভাদাইল ও আশুলিয়ার বিভিন্ন শ্রমিক এলাকায় পাহাড়িরা স্বজাতির লোকদের এ ধরনের সমাজ বিরোধী কাজের কারণে বিব্রত ও অতিষ্ঠ। কিন্তু সাভারে একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ও অপরাধী চক্রের সাথে যোগসাজশ থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুুলতে পারত না। বিভাষ চাকমা ১৯৮৯ সালে সারেন্ডার-করা এরশাদ আমলে চাকরি-লাভকারী শান্তিবাহিনী, সমাজে ঘৃণ্য প্রকৃতির ব্যক্তি হিসেবে নিন্দিত। বর্তমানে চাকরিচ্যুত, বেকার ও যাবতীয় দুষ্কর্মের প্রধান হোতা। ধৃত দিলীপ চাকমাসহ অপরাধী চক্রের অধিকাংশই বেকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সমাজ পরিত্যক্ত অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত। সমাজে সবাই এদের হেয় চোখে দেখে থাকে।
আশুলিয়া থানার বুড়িবাজার গাজিরচট এলাকায় শাখাওয়াত মিঞার বিল্ডিংকে (‘প্রমেশ ফ্লাট’ হিসেবে পরিচিত) বিভাষ-দিলীপ গং দীর্ঘ দিন ধরে মদ তৈরীর কারখানা বানিয়ে গোটা এলাকায় সাপ্লাই দিয়ে আসছে এবং এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে। এ নিয়ে আগেও বেশ ক’বার ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছিল, চিহ্নিত একটি প্রভাবশালী চক্র তাদের পক্ষে থাকায় বারে বারে পার পেয়ে যায়। ভবনটির মালিক শাখাওয়াত মিঞা বাড়ি ভাড়া দিয়ে নিজে ঢাকায় থাকেন। এ সুযোগে বিল্ডিং-এর তৃতীয় তলায় পাহাড়ি দুর্বৃত্ত চক্রটি স্থানীয় অপরাধীদের যোগসাজশে মদ-জুয়া-অপহরণ-চাঁদাবাজী-মুক্তিপণ আদায়ের আস্তানায় পরিণত করে সকল প্রকার অবৈধ কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভয়ে এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সবাই সন্ত্রস্ত থাকে। একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও এলাকার মাস্তানদের সাথে যোগসাজশ থাকার কারণে পাহাড়ি-বাঙালি দুর্বৃত্তদের এমন সমাজবিরোধী কর্মকা-ে স্থানীয়রা পর্যন্ত বাধা দেয়ার সাহস পায় না।
২৬ জুন রাতে পুুলিশী অভিযানের সময় শাখাওয়াত মিঞা বিল্ডিং-এর দারোয়ান শ্বস্তি প্রকাশ করে বলেন,‘এরা লোক ভালা না। বদমায়েশ টাইপের। সারা দিন মদ খায়, ঝগড়া করে। এলাকার পরিবেশ এরা খারাপ করছে। আগেই এদের ধরা উচিত ছিল।’
দাগী অপরাধী দিলীপ চাকমা ও তার সহযোগী আসেন্টু চাকমা পুলিশের হাতে ধরা পড়ায় সাভারে পাহাড়ি শ্রমিক এলাকায় লোকজন শ্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। অপর দাগী অপরাধী বিভাষ চাকমাসহ অন্যান্যদেরও দ্রুত অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা দরকার বলে বিল্ডিং-এর অন্যান্য ভাড়াটিয়া, আশেপাশের দোকানীসহ স্থানীয় লোকজন এ মত দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাভারস্থ পাহাড়ি শ্রমিকদের কয়েক জন এ ধরনের অপকর্মের পেছনে খোদ সন্তু লারমা দায়ী বলেও মন্তব্য করেছেন। তারা এও অভিযোগ করেন, বিভিন্ন সময় আঞ্চলিক পরিষদে অপরাধীরা আতিথেয়তা লাভ করে থাকে, শ্রমিকদের বিভক্ত রেখে নিজ স্বার্থ হাসিলের মতলবে সন্তু লারমা সমাজ বিরোধী অপকর্মে মদদ দিয়ে থাকেন, যা সাধারণ শ্রমিকরা কেউ মানতে পারে না। কিয়্যঙ পরিচালনা, এমনকী বাৎসরিক পিকনিক আয়োজন নিয়ে মাতব্বরী করার কারণে ঢাকাস্থ উচ্চ পদস্থ পাহাড়ি চাকুরীজীবীদের সাথে সন্তু লারমার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে চাকুরীজীবীরা ভীষণ ক্ষুব্ধ।
ধৃত অপহরণকারীরা বর্তমানে রিমান্ডে রয়েছে। আদালতে প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, পুলিশ ভ্যানে করে রিমান্ডে নেবার সময় অপরাধীরা জামাতি স্টাইলে হাত নেড়ে নেড়ে চলে যায়। তাদের এ ধৃষ্টতা দেখে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন, দুর্বৃত্তদের ছাড়িয়ে আনতে সন্তুগ্রুপ তৎপর হবে। সাভারের লোকজন দুর্বৃত্তদের গড় ফাডারদের পরবর্তী খেলা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।
——————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।