প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনে সেনা-প্রশাসনের বাধার প্রতিবাদে

২৪ মে খাগড়াছড়ি জেলায় অর্ধ দিবস সড়ক অবরোধের ডাক পিসিপি’র

0

সেনা-প্রশাসনের প্রবল বাধার মুখে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশ রূপ নেয় প্রতিবাদ বিক্ষোভে

PCP dighinala4

দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি) : জাঁকজমকপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে তিন সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রীর অংশগ্রহণে দীঘিনালার বানছড়া উচ্চ বিদালয় মাঠে পিসিপি’র ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশ ও শোভাযাত্রার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও সেনা-প্রশাসনের প্রবল বাধার মুখে আজ ২০ মে শুক্রবার তা প্রতিবাদ বিক্ষোভে রূপ নেয়। উক্ত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে পিসিপি’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সমাবেশে অন্যায় জবরদস্তিমূলক বাধাপ্রদান, নাগরিক অধিকারহরণ, সেনা-প্রশাসনের ফ্যাসিবাদী দমন নীতির প্রতিবাদে আগামীকাল ২১ মে শনিবার বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ২৪ মে মঙ্গলবার খাগড়াছড়ি জেলায় অর্ধ দিবস সড়ক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)।

রাস্তায় রাস্তায় সেনা টহল, অস্থায়ী চেকপোস্ট স্থাপন-তল্লাশি-হয়রানি ও গোয়েন্দা নজরদারি উপেক্ষা করে আজ সকাল সাড়ে দশটায় দীঘিনালার পাবলাখালি প্রাইমারি স্কুল মাঠে পিসিপি ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশ সংক্ষিপ্তভাবে সম্পন্ন করেছে। এ সময় সমাবেশে ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত অতিথিগণও পিসিপি’র সাথে ছিলেন। অপরদিকে, বানছড়া স্কুল মাঠ সেনা জওয়ান কর্তৃক অবরুদ্ধ থাকার কারণে সেখানে পিসিপি’র কর্মীগণ একত্রিত হতে সক্ষম হয় নি, তার পরিবর্তে বাঘাইছড়িমুখ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীরা জড়ো হয়ে আরও একটি সমাবেশ করে। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টিজনিত বৈরী আবহাওয়ার কারণে সকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি ও সেনা-প্রশাসনের বাধা হুমকিমূলক অবস্থান কোন কিছুই পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের লড়াইয়ে নিবেদিত পিসিপি’র অকুতোভয় কর্মীদের নিরস্ত করতে পারে নি।

পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশস্থল বানছড়া স্কুল থেকে ৫০০ গজ দূরে আমতলি এলাকায় পাবলাখালী প্রাইমারি স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সিমন চাকমা। এতে বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফ দিঘীনালা ইউনিটের সংগঠক সুকীর্তি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক থুইক্যচিং মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রিনা চাকমা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্য-এর সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল মাহমুদ, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক বিপ্লব ভট্টাচার্য, ছাত্র গণমঞ্চের সভাপতি সাঈদ বিলাস ও স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক অনিল চাকমা। সভা পরিচালনা করেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বিপুল চাকমা। সভার শুরুতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণে এক মিনিটি নিরবতা পালন করা হয় বলে পিসিপি’র সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

সভায় বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের আহ্বায়ক বিপ্লব ভট্টাচার্য বলেন,‘এতদিন ঢাকায় বসে পাহাড়ে নিপীড়ন নির্যাতনের কথা শুনতাম। আজ এখানে এসে তা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম।’

ছাত্র গণমঞ্চের সভাপতি সাঈদ বিলাস তার বক্তব্যে পাহাড়ে সেনা দমন-পীড়নের তীব্র নিন্দা এবং পিসিপি’র আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যের সমন্বয়ক ফয়সাল মাহমুদ তার বক্তব্যে বলেন,‘পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় যে নিপীড়ন চলে, পাহাড়ে বর্তমানে যা চলছে তা তার চেয়েও ভয়াবহ।’ দমন-পীড়ন চালিয়েও পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানিরা পরাস্ত হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামেও পরাস্ত হতে বাধ্য হবে, নিপীড়িত জনগণেরই জয় হবে বলে ফয়সাল মাহমুদ মন্তব্য করেন।

গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক থুইক্যচিং মারমা সভায় মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দমনমূলক ‘১১ নির্দেশনা’ জারির পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন নির্যাতন চরমে উঠেছে। তিনি সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এম. সাখাওয়াত হোসেনের বিভিন্ন লেখার তীব্র সমালোচনা করেন এবং তার মত একজন উপনিবেশিক মানসিকতাসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে মিডিয়ায় স্থান না দেয়ারও আহ্বান জানান।

পিসিপি’র সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, সেনা ও প্রশাসনের বাধার কারণে পিসিপি বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করেছে। বিভিন্ন স্থানে আহূত প্রতিবাদ সভায় নেতৃবৃন্দ প্রশাসন ও সরকার কর্তৃক পিসিপি’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে বাধা প্রদানের মতো অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। বক্তাগণ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, সমাবেশে বাধা দিয়ে, নেতা-কর্মীদের হুমকি ধামকি দিয়ে, জেল-জুলুম নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়ে এবং পেশীশক্তি প্রদর্শনের মহড়া দেখিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জনগণকে দমন করা যাবে না। ছাত্রসমাজ যে কোন মূল্যে গণতান্ত্রিক অধিকারসহ পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নিতে প্রস্তুত রয়েছে। প্রশাসনের বাধা কৌশলে উপেক্ষা করে বিভিন্নস্থানে পিসিপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সমাবেশ সফল করার জন্য ছাত্র-যুব সমাজ ও জনগণকে পিসিপি’র নেতৃবৃন্দ অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানান।

পিসিপি’র সমাবেশে বক্তারা সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাক্যাম্প তুলে নেয়ার মিথ্যা আশ্বাস দেয়, অন্যদিকে নিজেরাই সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় দমনমূলক বিতর্কিত ‘১১দফা নির্দেশনা’ জারি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সরকারের দ্বিমুখী নীতি পরিহার করার জন্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া সমাবেশ থেকে বক্তারা সকল স্থায়ী অস্থায়ী সেনাক্যাম্প সরিয়ে নেয়াসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণের’ মাধ্যমে সেনা কর্তৃত্ব অবসানের দাবি জানান। নেতৃবৃন্দ সরকারের প্রতি পরামর্শ প্রদান করে বলেন, সেনাশাসন জারি রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের প্রচেষ্টা সরকারের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। তাই সময় থাকতে সেনা শাসন প্রত্যাহারের জন্য তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

পাবলাখালি প্রাইমারি স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত সভায় পিসিপি’র সভাপতি সিমন চাকমা সেনা-প্রশাসনের ফ্যাসিবাদী আচরণ ও দমন নীতির প্রতিবাদে কাল ২১ মে বিক্ষোভ প্রদর্শন আর ২৪ মে মঙ্গলবার খাগড়াছড়ি জেলায় অর্ধ দিবস সড়ক অবরোধের ঘোষণা দিলে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীরা তুমুল করতালি দিয়ে তা স্বাগত জানায়। যে কোন মূল্যে ঘোষিত কর্মসূচি সফল করার শ্লোগান দেয়। এ সময় সমাবেশস্থলে যে কোন মুহূর্তে সেনা টহল দলের হানা দেয়ার আশঙ্কা থাকলেও পিসিপি’র নেতা-কর্মীগণ ছিলেন অবিচল ও নিশঙ্কচিত্ত, সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পিসিপি’র দুর্দান্ত সাহসী কর্মীরা বৃষ্টিভেজা মাঠে সারিবদ্ধভাবে বসেছিলেন।

পিসিপি’র সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতি বছরের মতো এ বছরও পিসিপি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী যথাযথভাবে পালনের ঘোষণা দেয়। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে (জেলা, উপজেলা পর্যায়ে) পিসিপি’র কর্মসূচি ও কার্যক্রম বিষয়ে অবগত করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সমাবেশ উপলক্ষে দীঘিনালার বানছড়া স্কুল মাঠের নির্ধারিত জায়গায় প্যান্ডেল ও মঞ্চ বানাতে গেলে গতকাল ১৯ মে বিকালে স্থানীয় সেনাবাহিনীর একটি টীম যুদ্ধংদেহী হয়ে প্যান্ডেল ও মঞ্চের স্থান দখল করে নেয়। পরে আরও সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে পিসিপি’র প্রতিষ্ঠাবর্ষিকীর মঞ্চ ও প্যান্ডেলের সকল সরঞ্জাম তছনছ করে দেয় এবং পিসিপি নেতাকর্মীদের হুমকি ধামকি ও বন্দুকের ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। যৌক্তিকভাবে প্রতিবাদ জানালেও সেনাবাহিনীর সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতে লিপ্ত না হয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীগণ বানছড়া স্কুলের নির্ধারিত স্থানে বিশাল সমাবেশ আয়োজনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। পিসিপি নেতৃবৃন্দ একস্থানে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশ না করে বিভিন্ন স্থানে পৃথকভাবে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে অনুযায়ী কর্মসূচি সফল করতে সক্ষম হয় বলে পিসিপি’র সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

সংবাদপত্রে প্রেরিত পিসিপি’র প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয় যে, গতকাল ১৯ মে বিকেলের দিকে দীঘিনালায় বানছড়া স্কুলের আমতলায় পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশস্থলের মঞ্চ ভেঙে দিয়ে এলাকায় সেনা টহল, চেকপোস্ট স্থাপন ও হুমকিমূলক অবস্থান জোরদারের কারণে জেলা সদর খাগড়াছড়িসহ অন্যান্য উপজেলা এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পিসিপি’র কর্মী-সমর্থকগণ দীঘিনালায় পৌঁছতে পারে নি, সকল প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও জড়ো হতে পারে নি স্থানীয় ছাত্র-যুবকরাও। পিসিপি’র বিক্ষুব্ধ কর্মীরা দীঘিনালাসহ বিভিন্ন এলাকায় ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত প্রচারপত্র বিলি করেছে, এলাকার বিভিন্ন প্রান্তে ছেঁটে দিয়েছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পোস্টার। দীঘিনালা ছাড়াও মহালছড়ি, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা-গুইমারা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি স্থানে বিক্ষুব্ধ পিসিপি’র কর্মীরা খণ্ড খণ্ডভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছে বলে জানা গেছে।
—————

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More