মতামত

ইউপিডিএফের উপর এত দমনপীড়ন কেন?

0

।। এম চাকমা ।।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠীর দমনপীড়ন এখন তুঙ্গে। দলের সদস্য ও সমর্থকদের গ্রেফতার, নির্যাতন, জেলজুলুম, এমনকি তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ও ‘গোলাগুলিতে’ কিংবা রাজাকার দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা যেন স্বাভাবিক দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউপিডিএফ একটি গণতান্ত্রিক দল হলেও সভা সমাবেশ করার মতো ন্যুনতম গণতান্ত্রিক অধিকার থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশ দূরের কথা, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পর্যন্ত পালনে বাধা দেয়া হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা সদর থেকে বহু দূরে মিছিল সমাবেশ আয়োজন করা হলেও তাতে বাধা দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছুটে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইউপিডিএফের সামান্য একটি পোস্টার, লিফলেট কিংবা ফেস্টুনও যেন এখন শাসকগোষ্ঠীর জন্য এক বড় আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। তা না হলে বিভিন্ন জায়গায় লাগানো পোস্টার ছিঁড়ে দেয়া হবে কেন, ফেস্টুন খুলে নেয়া হবে কেন কিংবা দেয়াল লিখন মুছে দেয়া হবে কেন?

ইউপিডিএফের উপর নিপীড়ন নির্যাতন নতুন কিছু নয়, যদিও তা বর্তমানে চরম রূপ নিয়েছে। গঠনের শুরু থেকেই এই দলটিকে শাসকগোষ্ঠীর বহুর্মুখী দমনপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই এই সব ঘটনার মোকাবিলায় ইউপিডিএফের সকল স্তরের নেতা-কর্মীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রত্যেক নাগরিকের একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও পার্বত্য চুক্তি সমালোচনার কারণে একমাত্র ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। চুক্তি বিরোধী আখ্যায়িত করে তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে, গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে আজ পযন্ত গত ২২ বছরে তাদের ৩ শতাধিক নেতা, কর্মী ও সমর্থক খুন ও গুমের শিকার হয়েছেন। জনসংখ্যার আনুপাতিক বিচারে এই সংখ্যা অনেক বেশী। তাই যদি বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে অন্য কোন পার্টিকে কেবল এতদূর আসতে ইউপিডিএফের মতো এত বিপুল ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি, তাহলে তা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না।

কিন্তু এত নিপীড়ন সত্বেও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক পন্থার আন্দোলনের প্রতি তার দলীয় অঙ্গীকার থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হয়নি। শাসকগোষ্ঠীর ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত নীতি, অর্থাৎ জুম্মদের মধ্যে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি জিইয়ে রাখার অপচেষ্টা, সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল, পাহাড়ি উচ্ছেদ, নারী নির্যাতন তথা সরকারের সকল অগণতান্ত্রিক, গণবিরোধী ও ফ্যাসিষ্ট কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আ্ন্দোলন গড়ে তুলেতে ইউপিডিএফ সব সময় গণতান্ত্রিক পন্থাকেই বেছে নিয়েছে। অথচ সরকার বা শাসকগোষ্ঠী ইউপিডিএফের এই গণতান্ত্রিক পন্থার আন্দোলনকে দমন করতে চাইছে সম্পূর্ণ সামরিক উপায়ে – অর্থাৎ উগ্র ও বর্বর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। তাই বর্তমান সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে একটি বিষয় কারোর নজর এড়িয়ে যেতে পারে না – আর সেটি হলো, শাসক বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য সাঁড়াশির মতো ইউপিডিএফকে গলা টিপে ধরে শেষ করে দিতে এখন উদ্যত।

মোট কথা, গত ২২ বছরে ইউপিডিএফকে ধ্বংস করার জন্য এমন কোন কৌশল নেই যা প্রয়োগ করা হয়নি। জুম্মদের মধ্যে তথাকথিত চুক্তি-পক্ষের সমস্ত শক্তিকে ব্যবহার করে এই পার্টিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে (এর আরও একটি উদ্দেশ্য হলো যাতে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন গড়ে না উঠে), সশস্ত্র সন্ত্রাসী মুখোশ বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয়েছে, দলচ্যুতদের দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ দল গঠন করে খুনের মহোৎসব পালন করা হয়েছে, রাজাকারসহ সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ব্যবহার করা হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইউপিডিএফের উপর কেন এত দমন পীড়ন? কেন তাকে তার সংবিধান-প্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? ইউপিডিএফের কী অপরাধ, যার জন্য তাকে ধ্বংস করতে মরিয়া হতে হবে? শাসকগোষ্ঠীর কাছে এইসব রূঢ় প্রশ্নের উত্তর জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।

তবে আজ এটাও বলতে চাই, এত চাপ, এত ক্লেশ, এত দমনপীড়ন, এত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ২২ বছর ধরে কেবল নিজের শক্তির উপর নির্ভর করে মাথা উঁচু করে ঠিকে থাকা যে কোন পার্টির জন্যই গর্বের বিষয়। যে জাতির জনগণ এমন একটি মহান পার্টির জন্ম দেন ও মায়ের মতো আগলে রেখে রক্ষা করেন তারাও পার্টির এই সাফল্য ও গর্বের সমান অংশীদার হতে পারেন।

আসলে যে পার্টি সঠিক নীতি আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত, যার শেকড় জনগণের মধ্যে প্রোথিত এবং যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মী ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত, সেই পার্টিকে কোনভাবেই ধ্বংস করা যায় না। সংগ্রামের ২২ বছর পেরিয়ে ইউপিডিএফের নেতাকর্মীরা নিশ্চয়ই বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন। ‍তবে তাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না, পথ এখনও অনেক দূর। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এখনও ক্ষান্ত হয়নি। তাই এত বছরের অর্জনে বিনীত হয়ে গর্ব করা গেলেও কিছুতেই অহংকারী হওয়া যাবে না। অহংকার যাতে পার্টির কোন নেতার, কোন কর্মীর মনে মুহুর্তের জন্যও স্থান না পায় সে ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। অহংকার ও আত্মতুষ্টিকে দালাল প্রতিক্রিয়াশীলদের মতোই শত্রু জ্ঞান করতে হবে এবং নিজের মধ্যে সংগ্রামের মাধ্যমে তাকে পরাস্ত করতে হবে।#

 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত/প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More