লামায় ম্রো-ত্রিপুরা পাড়াবাসীদের জমি বুঝিয়ে দেয়ার সুপারিশ করেছে মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি
ডেস্ক রিপোর্ট, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ২৩ মে ২০২৩

বান্দরবানের লামা উপজেলার ৩০৩ নং ডলুছড়ি মৌজার লাংকম কার্বারিপাড়া, রেংয়েন কার্বারিপাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়াবাসীকে দ্রুততার সাথে তাদের জমি বুঝিয়ে দেয়াসহ ৭ দফা সুপারিশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি। এতে ইতোপূর্বে তিনটি পাড়ার ভূমি বন্দোবস্তি দেয়া হয়ে থাকলেও যে সকল স্থানে পাহাড়িরা বসবাস করে সেই সকল স্থানের ভূমি বন্দোবস্তি বাতিল করারও কথা বলা হয়েছে।
গত ১২ এপ্রিল ২০২৩ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বেঞ্চ-১ এর সভাপতি ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত এক আদেশনামায় (নং ১০) এই সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশনের অবৈতনিক সদস্য কংজরী চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটি কর্তৃক যে সব সুপারিশ করা হয়েছে বলে আদেশনামায় উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো:
“০১। বান্দরবান লামা উপজেলার লংকম কারবাড়িপাড়া, রেংয়েন কারবাড়িপাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ৩০৩ নং ডলুছড়ি মৌজার জমি দ্রুততার সাথে পরিমাপ করে সংশ্লিষ্টদের বুঝিয়ে দেবার জন্য জেলা প্রশাসক, বান্দরবানকে বলা হোক।
০২। উল্লেখিত তিনটি পাড়ার ভূমি যদি ইতোপুর্বে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েও থাকে তাহলে যেসকল স্থানে পাহাড়িরা বসবাস করে সেই সকল স্থানের ভূমি বন্দোবস্ত বাতিল করে পাড়াবাসীদের বুঝিয়ে দেবার জন্য জেলা প্রশাসক, বান্দরবান-কে বলা যেতে পারে।
০৩। যাতায়াতের রাস্তা ঠিক করার জন্য জেলা প্রশাসক, বান্দরবান-কে বলা যেতে পারে।
০৪। পাহাড়বাসীদের অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যাতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিনিয়র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ এবং সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলা যেতে পারে।
০৫। এধরণের ঘটনার পর মানবিক বিপর্যয় শুরু হয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান যাতে দ্রুততার সাথে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে বলা যেতে পারে।
০৬। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বিষয়গুলো দেখার জন্য তৈরী করা হলেও এধরণের ঘটনায় তাদের উপস্থিতি এবং ব্যবস্থা গ্রহণ পর্যাপ্ত নয়। এই সব পরিস্থিতি মোকাবেলয় যাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা হয় সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বলা যেতে পারে।
০৭। তর্কিত ৪০০ একর জমির সমস্যার সমাধান যতদিন না হয় ততদিন পর্যন্ত উভয় পক্ষকে তর্কিত জমিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার ব্যবস্থা করার জন্য জেলা প্রশাসক, বান্দরবান-কে বলা যেতে পারে।”
উক্ত আদেশনামায় ইতোপূ্র্বে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা ও এ বিষয়ে কমিশনের আদেশ প্রদান এবং জেলা পরিষদের তদন্ত কমিটির সুপারিশ, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তম্মধ্যে বান্দরবান জেলা পরিষদের তদন্ত কমিটির পেশকৃত সুপারিশের কথা উল্লেখ করে আদেশনামায় বলা হয়, ‘বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলার লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ এর অনুকুলে কোন জমি লীজ দেয়া হয়নি। এ জেলায় এককভিত্তিক বিভিন্ন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে লামা উপজেলার ৩০৩ নম্বর ডলুছড়ি ও ৩০১ নম্বর সরই মৌজার আওতাধীন ২৫.০০ একর করে জমি লীজ দেয়া হয়। তন্মধ্যে ৬৪ জন লীজ গ্রহীতা একত্রীভূত হয়ে তৎকালীন স্টাডিং কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ গঠন করেন। বিবাদমান আনুমানিক ৪০০.০০ (চারশত) একর জমির মধ্যে কোন কোন জমি লীজ গ্রহীতাদের বাগান তা জরিপ করা দুরূহ। তর্কিত জমি ডিজিটাল জরিপের দ্বারা নির্দিষ্ট করণের মাধ্যমে উদ্ভুত দ্বন্দ্ব নিরসনকল্পে সহায়তা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পত্র: ৬৩৩; ২১ জুলাই ২০২২ মূলে সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়কে পত্র দেয়া হয়।
তদন্ত কমিটির প্রদত্ত সুপারিশ মোতাবেক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বান্দরবান পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) / অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট / অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) গণকে পত্র দেয়া হয়।
গত ১৬ আগস্ট ২০২২ তারিখ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরে আদেশনামায় বলা হয়, “জেলা প্রশাসক, বান্দরবানের প্রতিবেদনে পাড়াবাসী কর্তৃক সকলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে তাদের সিন্ধান্ত জেলা প্রশাসককে জানানোর বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও কি বিষয়ে আলোচনা করে জানাতে হবে তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। বিষয়টি স্পষ্টিকরণের প্রয়োজন ছিল। এছাড়া প্রতিবেদনে পরিস্থিতি শান্ত থাকার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু বিভিন্ন পত্র পত্রিকা মারফত দেখা যায় স্থানীয়দের বিভিন্ন ভাবে এখনও হয়রানি করা হচ্ছে এবং তারা এখনও খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাবে রয়েছে। উল্লেখিত ক্ষতিগ্রস্থদের প্রতিনিধি হিসেবে জনাব রুংধজন ত্রিপুরা কমিশনে এসে লিখিত এবং মৌখিক ভাবে তাদের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয় যে, ইতোপূর্বে এবিষয়ে তারা মামলা দায়ের করলেও মুল আসামীরা এখনও ধরা ছোয়ার বাইরে। প্রতিপক্ষ তর্কিত স্থানে চারা রোপন করছে। চারা রোপনে বাধা দিলে প্রতিপক্ষরা তাদের উপর হামলা করে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়।
এঅবস্থায়, সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয়দের বসবাস, খাদ্য, পানি ও জীবন ধারণের অন্যান্য বিষয়গুলি সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠি যাতে কোন ধরণের নির্যাতনের শিকার না হয় অর্থাৎ তাদের মানবাধিকার সমুন্নত রাখার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমিশনকে অবহিত করার জন্য জেলা প্রশাসক, বান্দরবানকে বলা হয়।”
এতে বলা হয়, “পরবরর্তীতে ০২ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে পুনরায় বান্দরবানের লামায় সরই ইউনিয়নের ম্রোদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুরের অভিযোগ উঠে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে। ম্রোদের অভিযোগ জায়গা দখলের উদ্দেশ্যে মূলত এই হামলা, অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। রোববার রাত ১ টার দিকে রেঙয়েন কারবারী পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে ম্রো ও ত্রিপুরাদের জায়গা দখল করে নেওয়ার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করছে। রোববার রাত ১টার দিকে ট্রাকভর্তি লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে এসে পাড়ায় হামলা চালিয়েছে রাবার কোম্পানির লোকজন। সাতটি বসত ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হলে তিনটি বাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। রাম রুম ম্রো, সিং চং ম্রো ও রেং ইয়ুং ম্রো এই তিনজনের ঘর পুড়ে যায়। এছাড়া ১০টি ঘরে ভাঙচুর চালানো হয়। বেশ কয়েকজনকে মারধর করে হামলাকারীরা। রেঙয়েন কারবারীর অভিযোগ, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত দেলোয়ার, মহসিন ও নুরুর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি দল পাড়ায় অগ্নিসংযোগ, হামলা চালিয়েছে।
এ ঘটনায় কমিশন তীব্র নিন্দা জানায় এবং আদেশ দেয়া হয় যে,
“১। ক্ষতিগ্রন্থ সকল পরিবারকে পর্যাপ্ত খাদ্য, পানি এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে গৃহ নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে বলা হোক।
২। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বলা হোক ।
৩। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও ভুক্তভোগীরা যাতে কোন হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিনিয়র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-কে বলা হোক।”
এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়-২ অধিশাখা এর নিকট থেকে ১৫/০২/২০২৩ খ্রিঃ তারিখের ২৯.০০.০০০০.২২.৪.২৭.৩৪.২০১৭.৭৬ এবং ৭৭ স্মারকে সিনিয়র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ এবং জেলা প্রশাসক, বান্দরবান পার্বত্য জেলা বরাবর প্রেরিত দুইটি পত্রের অনুলিপি পাওয়ার কথাও তুলে ধরে বলা হয়, ‘পত্র দুইটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এবং স্থানীয়দের বসবাস খাদ্য, পানি ও জীবন ধারণের অন্যান্য বিষয়গুলি সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী যাতে কোন ধরণের নির্যাতনের শিকার না হয় অর্থাৎ তাদের মানবাধিকার সুমন্নত রাখার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।’
আদেশনামায় বলা হয়, উল্লিখিত দপ্তর সমূহের নিকট থেকে প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি বিধায় আগামী ১২/০৬/২০২৩ তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেয়া হোক।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন