সাজেকে অপহৃত তিন গ্রামবাসীর মুক্তির দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের আসতে দেয়নি সেনাবাহিনী!

বাঘাইছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
রাঙামাটির সাজেক ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের রাঙ্গাপানি ছড়া গ্রামের ৬ গ্রামবাসী গত ১ জুলাই জেএসএস সন্তু গ্রুপ কর্তৃক অপহৃত হন। সেখান থেকে গত ২৬ আগস্ট ২০২৫ সন্তু গ্রুপের জিম্মিদশা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন তিন গ্রামবাসী।
পালিয়ে আসা এই তিন গ্রামবাসীকে নিয়ে বাকী আরও ৩ গ্রামবাসীকে উদ্ধারের দাবিতে গণ অধিকার রক্ষা কমিটির উদ্যোগে আজ মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সাজেকের উজো বাজারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের আসতে দেয়নি সেনাবাহিনী। সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে আসার পথে দীঘিনালা সেনাজোন থেকে সুকৌশলে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্টনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, আজ সকাল ১০টার সময় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা সংবাদ সম্মেলনে যোগদান করতে আসার পথে দীঘিনালা সেনা জোনে তাদেরকে আটকানো হয়। প্রথমে তাদেরকে গোলঘরে বসানো হয়, পরে সরাসরি জোন কমাণ্ডারের কক্ষে ডাকা হয়। এরপর দীঘিনালা জোন কমাণ্ডার লে. কর্ণেল মো. ওমর ফারুক (৪ বেঙ্গল) সাংবাদিকদের সাথে কথাবার্তা বলেন এবং চা-নাস্তা আপ্যায়নের একপর্যায়ে তাদেরকে সাজেকে না গিয়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
এদিকে, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও সংবাদকর্মীরা না আসায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার এক সাংবাদিক তাদেরকে দীঘিনালা জোনের গোলঘরে বসিয়ে রাখা ও সেখান থেকে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি জানান এবং সংবাদ সম্মেলনে আসা সম্ভব হচ্ছে না বলে নিশ্চিত করেন।
পরে বেলা ২টার সময় সংবাদ সম্মেলনের পরিবর্তে উপস্থিত মুরুব্বীদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত সভা করে জিম্মি দশা থেকে পালিয়ে আসা গ্রামবাসীরা তাদের তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
সন্তু গ্রুপের হাতে যে ৬ গ্রামাবাসী অপহরণের শিকার হয়েছিলেন তারা হলেন- ১. ধন মনি চাকমা (২০), পিতা- মঞ্জুগুলো চাকমা, ২. সম বিকাশ চাকমা (২৭), পিতা-পুনং চান চাকমা, ৩। সুবেশ চাকমা(২৭), পিতা- মঞ্জুগুলো চাকমা, ৪. ভাঙাহা্দা চাকমা(৪৫), পিতা-অজ্ঞাত, ৫. লক্ষী শান্তি চাকমা(৪৮), পিতা-কিনা চান চাকমা, ৬. খুল্যা চাকমা-(৩৮), পিতা-আদে চন্দ্র চাকমা। তারা সবাই রাঙ্গাপানি ছড়া গ্রামের বাসিন্দা ও সাধারণ জুমচাষী।
অপহরণের দীর্ঘ প্রায় ২ মাস ধরে তাদের কোন খোঁজ পাওয়া না গেলেও গত ২৬ আগস্ট অপহৃতদের মধ্য থেকে ধন মনি চাকমা, সম বিকাশ চাকমা ও সুবেশ চাকমা সন্তু গ্রুপের জিম্মিদশা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। তবে বাকী আরো ৩ জনের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
জিম্মিদশা থেকে পালিয়ে আসা তিন গ্রামবাসীর তথ্যমতে তাদেরকে অপহরণের সাথে জড়িতরা হলেন- সন্তু লারমার পরিচালিত সশস্ত্র গ্রুপ কমান্ডার বিক্রম চাকমা, বরুন চাকমা, সাইমন চাকমা ও তাদের দলবল।
বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে জিম্মিদশা থেকে পালিয়ে আসা তিন গ্রামবাসীকে নিয়ে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া কর্মীদের উপস্থিতিতে সাজেক গণ অধিকার রক্ষা কমিটি সাজেকের উজোবাজারে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজনের উদ্যোগ নেয়।
কিন্তু সেনাবাহিনীর বাধায় সংবাদ কর্মীরা উপস্থিত হতে না পারায় সেখানে উপস্থিত মুরুব্বীদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত সভা করা হয়। এতে কথা বলেন, সাজেক গণ অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাহেন্দ্র ত্রিপুরা ও সদস্য সচিব বাবুধন চাকমা। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন সাজেক কার্বারি এসোসিয়েশনের সভাপতি নতুন জয় চাকমা, জুমচাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি জ্যোতি লাল চাকমা, সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটির সভাপতি ব্রজ কুমার চাকমা ও এলাকার বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ।
সভায় জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিরা তাদেরকে অপহরণের ঘটনা তুলে ধরেন।
সভায় মাহেন্দ্র ত্রিপুরা ও বাবুধন চাকমা সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের আসার পথে সেনাবাহিনীর বাধাদানের ন্যাক্কারজনক ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
বাবুধন চাকমা বলেন, আমরা নিরীহ তিন গ্রামবাসীর মুখ থেকে বর্ণনা শুনে অপহরণকারীদের সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম। এই তিনজন আসলে নিরীহ ও অসহায় গ্রামবাসী। এই নিরীহ ব্যক্তিদের সন্তু লারমা তার সশস্ত্র দলবল কর্তৃক মিথ্যা অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন করে তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। আমরা সাজেক গণ অধিকার রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তিনি অবিলম্বে সন্তু গ্রুপের হাতে জিম্মি থাকা বাকী ৩ গ্রামবাসীকে উদ্ধারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
তিনি সন্তু গ্রুপকে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক কাজ বন্ধ করে জাতির জন্য ভালো কাজ করার আহ্বান জানান।
মাহেন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, ভাগ্যক্রমে এই তিন জন প্রাণে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছেন। তিনি তাদেরকে পুনর্বাসনের দাবি জানান।
পালিয়ে আসা ৩ গ্রামবাসী জানিয়েছেন, সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র কমান্ডার বিক্রম চাকমা মিটিঙের কথা বলে তাদেরকে উদয়পুরে ডেকে নিয়ে আটক করে। প্রথম দুই দিন তাদেরকে থলছড়া নামক গ্রামে শিকলে বেঁধে রাখা হয় এবং প্রচন্ডভাবে মারধর করা হয়।
সেখানে দুই দিন, দুই রাত থলছড়ায় রাখার পর তৃতীয় দিন রাতে গাড়ি যোগে তাদেরকে দোজর বাজার উত্তর-পূর্ব দিকের একটি গ্রামে বিচ্ছিন্ন একটি বাঁশ পাতার ছাউনি দেয়া মাচাং ঘরে শিকল দিয়ে বেঁধে মিলন চাকমা ওরফে হেগা নামের একজনের বাড়িতে জিম্মি করে রাখে। এ সময় স্থানীয় পার্শ্ববর্তী তিনটি গ্রামের লোকজন রাতে ৪ জন, দিনে ৪ জন রুটিন মাফিক পালাক্রমে পাহারা দিয়ে রাখতো। তবে আরো ৩ জনকে কোথায় রেখেছে তা তারা জানাতে পারেনি।
তারা বলেন, “জিম্মিদশার সময় আমরা প্রতিনিয়তই দুঃশ্চিন্তায় থাকতাম। পাহারা দিতে আসা লোকজনের মধ্যে কেউ বলে আমাদের মেরে ফেলবে, কেউ বলে তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে- তাতে আমরা আরো বেশি দুঃশ্চিন্তায় থাকি।
“এক পর্যায়ে গত ২৬ আগস্ট তারিখ রাতে আমরা সেখান পালিয়ে আসতে সক্ষম হই। আসাার পথে রাস্তা-ঘাট চেনা-জানা ছিল না। তিন দিন, তিন রাত ভাত খাওয়া হয়নি। শুধুমাত্র ছড়ার শামুক, কাঁকড়া ও বাঁশকোড়ল খেয়ে খেয়ে ২৯ আগস্ট আমরা আমাদের জায়গায় এসে পৌঁছি।”
তারা এখন শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছেন বলে জানান।
সভা থেকে ৫ দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো:
১। অপহরণকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২। অপহৃত নিখোঁজ তিনজনকে উদ্ধারের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।
৩। সন্তু গ্রুপের জিম্মিদশা থেকে পালিয়ে আসা ৩ জনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও আর্থিকসহ যথাযথ পূনর্বাসনে প্রশাসনকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৪। তিন জনের পরিবার এখনো অপহরণকারীদের জিম্মায় রয়েছে, তাদেরকে সসম্মানে জিম্মিদশা থেকে মুক্তি দিতে হবে।
৫। সাজেকসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ জনগণের ওপর সন্তু গ্রুপের খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ সকল জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।