সমকাল থেকে

উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা থামান

0

শাহেদ কায়েস

করোনার দুঃসহ এই সময়, যখন মানুষ কর্মহীন হয়ে ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মধ্যে খেয়ে, না-খেয়ে কোনোরকমভাবে জীবনধারণ করছে; সেই সময়ে এ কী অত্যাচার-অবিচার! টাঙ্গাইলের মধুপুরে কয়েকদিন ধরেই জমি উদ্ধারের নামে স্থানীয় মান্দিদের (গারো) মাঠের ফসল ট্রাক্টর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান চালাচ্ছে বনবিভাগ! জনগণের করের টাকায় যাদের বেতন-ভাতা হয়, তারাই গুঁড়িয়ে দিচ্ছে জনগণের মাঠের ফসল! 

মধুপুর উপজেলার আরণখোলা ইউনিয়নের আমতলী গ্রামে ইতোমধ্যে ১০ গারো পরিবারের পাঁচ একর জমির আনারস, পেঁপে, আদা, হলুদ, কলা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। গেল সোমবার শোলাকুড়ি ইউনিয়নের পেগামারীতে দরিদ্র বাসন্তী রেমার জীবিকার একমাত্র অবলম্বন কলাবাগানটিও কেটে উজাড় করে দিয়েছে বনবিভাগ। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ লোকজন বনবিভাগের রেঞ্জ অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। শুনেছিলাম, বনবিভাগ বুধবার ক্ষতিগ্রস্থদের সঙ্গে বসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উত্তেজনা প্রশমন করেছে।

মঙ্গলবার খানিকক্ষণ আগে জানলাম, বসাবসির পরিকল্পনা বাতিল করা। বসবার দরকার কী? দরিদ্র কয়েকজন বনজীবী বনবাসীকে উচ্ছেদ করা হলে তো কিছু যায় আসে না। অথচ গাজীপুর থেকে মধুপুর পর্যন্ত বনের বহু জায়গায় আমরা শিল্প-কারখানা দেখতে পাই। এই সব দখলদারদের দোসর স্বয়ং বন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের এই বিভাগটি। বন বিভাগের এমন অবিমৃষ্যকারিতার তীব্র নিন্দা জানাই। মান্দি জাতিগোষ্ঠীর শস্য বিনষ্ট করে তাঁদের অন্যায়ভাবে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। 

আমাদের বন্ধু, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল একটা মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন মধুপুরের এই অঘটনের। প্রায় দুই দশক ধরে মধুপুরের মান্দি গ্রামগুলোতে তিতিলের যাতায়াত এবং সেখানকার মান্দিদের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক। তিতিল বলছিলেন, ‘চুনিয়ায় বসবাসের দিনগুলোতে মাঝেমাঝে প্যাগামারি গ্রামে যেতাম জনিক আচ্চুর সঙ্গে। বন পেরিয়ে, নিচু জমির আল ধরে। কারণ প্যাগামারি গ্রামে আমার দাদা-দিদিদের কয়েকজনের বাড়ি। ওখানে একদিন বাসন্তী এসে বলল, মানি (এক্ষেত্রে পিসি) আমি তোমার নামছিক (ভাইয়ের মেয়ে)। তোমাকে ফোন করব মাঝে মাঝে। আমার নাম বাসন্তী রেমা। বাসন্তী ফোন করেনি। কিন্তু দেখা হলেই উজ্জ্বল হাসি হেসে নানা কথা বলে। কাল খবর পেলাম বাসন্তীর কষ্টে গড়া কলাবাগান কেটে দিয়েছে বনবিভাগের লোকেরা। একটা ফসলের ক্ষেত গড়ে তুলতে কত পরিচর্যা, কত পরিশ্রম দরকার হয়! আমি জানি না। শুধু অনুমান করি। যত্নে গড়া ফসল চোখের সামনে কেটে নষ্ট করলে কেমন লাগে, সেটাও কেবল অনুমান করি। তাতেই খুব কান্না পায়।’

আদিবাসীদের নিয়ে এই উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা থামান। এই খেলা তো শুধু মধুপুরেই ঘটছে না। সুনামগঞ্জে গারো পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী গারোদের মাঠটি দখল করে নিচ্ছে সেটেলাররা (অন্য স্থান থেকে আসা বসতি স্থাপনকারী)। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের কড়ইগড়ার টিলাটি যুগ যুগ ধরে খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন আদিবাসী মান্দি (গারো) সম্প্রদায়ের লোকজন। নানা পার্বণ-অনুষ্ঠানে এই মাঠটিই তাদের ভরসা। স্থানীয় পর্যায়ে বেশ কয়েকবার সালিশ বৈঠক হলেও কোনো মীমাংসা হয়নি। এখন মাঠটিতে গারোদের ঢুকতে দিচ্ছে না সেটেলাররা। এ জন্য গত ৭ সেপ্টেম্বর গারো সম্প্রদায়ের লোকজন জনপ্রতিনিধি, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে মাঠটি ফেরত চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। কেননা, ১৯৪৮ সালে বড়গোপটিলাটির গাছগাছালি পরিষ্কার করে মাঠ বানিয়েছিলেন আদিবাসী মান্দিরা। অথচ মাঠে টানানো গারোদের পূর্বপুরুষের স্মৃতিচারণমূলক সাইনবোর্ডটি তুলে নিয়ে গেছে।

বন, পাহাড়, হাওর তো বটেই, এমন কী উত্তর জনপদের সমতলে বসবাসকারী আদিবাসীরা হারাচ্ছে ভূমির অধিকার। দিনের পর দিন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন এবং মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি করে আসছে। দাবি দুটি পূরণ হলে হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। কমবে উচ্ছেদ আতঙ্ক।

লেখক: কবি, পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মী 

shahedkayes@gmail.com

সূত্র: সমকাল

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More