মতামত
খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার হাসান মাহমুদের সংবাদ সম্মেলন: আমার কিছু প্রশ্ন

সজল চাকমা
আজ ৩০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্টে প্রেস ব্রিফিং করেছেন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের সামনে “ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের” কথা বলেছেন এবং ”ধর্ষণের ঘটনাকে পুঁজি করে সাধারণ পাহাড়ি নারী ও কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা” করার অভিযোগ তুলেছেন ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে। তিনি খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক সহিংসতার জন্যও ইউপিডিএফকে দায়ি করেছেন।
প্রেস ব্রিফিং-এ তার বক্তব্য ছিল কেতাদুরস্ত রাজনৈতিক নেতার মতো। কিন্তু জেনারেল সাহেব নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিকের মত প্রকাশ এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। এই অধিকার সংবিধান-স্বীকৃত, যা কোন নাগরিকের কাছে থেকে অন্য কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদেরকে কি সেই অধিকার ভোগ করতে দেয়া হচ্ছে? কেন ইউপিডিএফ একটি গণতান্ত্রিক দল হওয়া সত্ত্বেও তার সকল অফিস জোর করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে? কেন রাতে-বিরাতে যখন তখন পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে তল্লাশি করা হচ্ছে? অথচ বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ নং অনুচ্ছেদে ষ্পষ্ট বলা আছে: “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে।” অর্থাৎ আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া কোন নাগরিকের বাড়িতে ঢোকা, তল্লাশী করা ও সেখান থেকে কাউকে আটক করা বেআইনী।
অথচ এই বেআইনী কাজই জেনারেল মাহমুদের সৈন্যরা প্রতিদিন করে যাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে, অথচ পাহাড়ে এখনও আগের মতো হাসান মাহমুদের মতো জেনারেলদের ফ্যাসিস্ট শাসন চলছে। তাদের হুকুমেই সবকিছু চলছে। তারা যাকে ইচ্ছা তাকে আটক করে, যার বাড়িতে ইচ্ছা তার বাড়িতে ঢোকে, এমনকি যাকে ইচ্ছা তাকে গুলি করে মারে। এই হচ্ছে আজকের পার্বত্য চট্টগ্রাম, যাকে বলা হয় বাংলাদেশের অংশ, ভৌগলিকভাবে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে নয়। কারণ এই অঞ্চলের পাহাড়ি জনগণ তার রাজনৈতিক অধিকারের ন্যায্য অংশ পায় না।
সাম্প্রতিক দাঙ্গা প্রসঙ্গে জেনারেল সাহেবকে প্রশ্ন করতে চাই, আপনার এতগুলা বলবান সৈন্যের সামনে খাগড়াছড়ি শহরের কেন্দ্রস্থল মহাজনপাড়া ও য়ংড বৌদ্ধ বিহারের পাশে পাহাড়িদের ওপর কীভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উগ্রপন্থী সেটলাররা হামলা করতে পারে? দোকানঘরে ভাঙচুর করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরই আমরা আপনার কাছ থেকে আশা করেছিলাম। কিন্তু আপনি এই বিষয়ে কোন কথা না বলে এই দাঙ্গার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ি করলেন। এইভাবে ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ি করে নিজের দোষ স্খলন করার চেষ্টা আপনি করতে পারেন, কিন্তু সত্য সত্যই, তা কখনও মিথ্যা হয়ে যাবে না। আপনি ক্ষমতার জোরে অনেক কিছু করতে পারেন, কিন্তু কথার মারপ্যাচে কিংবা বন্দুকের নল দিয়ে সত্যকে মিথ্যা বানাতে পারবেন না।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর আপনার দেয়া উচিত ছিল। সেটি হচ্ছে, ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে “জুম্ম ছাত্র জনতার” নেতা উক্যনু মারমাকে মধুপুর বাজার এলাকা থেকে কেন জোর করে তুলে নিয়ে ব্রিগেড অফিসে আটক রাখলেন? সেদিন জনগণ যদি তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ না করতো, তাহলে তাকে নিশ্চয়ই মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকাতেন, — যেভাবে ইতিপূর্বে বিনা অপরাধে অসংখ্য পাহাড়িকে ঢোকানো হয়েছে।
সামান্য পেছনে ফিরে তাকালে দেখবেন, উক্যনু মারমাকে অন্যায়ভাবে আটক করার মাধ্যমে খাগড়াছড়ির পরিস্থিতিকে বিষ্ফোরন্মুখ করে তোলা হয়েছিল। মি. জেনারেল, এর দায়-দায়িত্ব আপনি কাকে দেবেন?
সংবাদ সম্মেলনে দেশবাসীকে আপনার জানানো উচিত ছিল – আপনারা খাগড়াছড়ির মহাজনপাড়া, য়ংড বৌদ্ধ বিহার ও গুইমারার রামেসু বাজারে সাম্প্রদায়িক হামলার সাথে জড়িতদের মধ্যে আজ পর্যন্ত কতজনকে গ্রেফতার করেছেন। অথচ সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়েও ছিলেন একদম নিশ্চুপ। কিন্তু কেন?
আপনার সৈন্যরা আজও (৩০ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর ও সিঙ্গিনালায় পাহাড়িদের দোকানে ও বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে। আমরা আপনার কাছ থেকে জানতে চাই, কেন আপনার সৈন্যরা কেবল পাহাড়িদের বাড়িঘরে ও দোকানে তল্লাশী করে? কেন হামলাকারীদের ধরার জন্য আপনার বাহিনীকে নির্দেশ দেন না? আসলে ইউপিডিএফ মিছিমিছি আপনার বিরুদ্ধে সেটলারদের প্রতি আপনার বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব ও পাহাড়ি বিদ্বেষের অভিযোগ তোলেনি। আর আজ আপনিও সেই অভিযোগের কোন উত্তর দিতে পারেননি। বরং তল্লাশি অভিযানের মাধ্যমে ইউপিডিএফের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করলেন।
মি. জেনারেল, যে উদ্দেশ্যে আপনি সংবাদ সম্মেলন করেছেন তা ব্যর্থ হয়েছে। ইউপিডিএফের দিকে যে তীর আপনি নিক্ষেপ করেছেন, সেটা আপনার জন্য বুমরাংই হয়েছে। আপনি খাগড়াছড়িতে উগ্র সেটলারদের আক্রমণ থেকে পাহাড়িদের রক্ষা করেননি। আপনি আপনার পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিরপেক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই গ্লানি নিয়ে যদি খাগড়াছড়ি ত্যাগ করতে না চান, তাহলে কাল বিলম্ব না করে হামলার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করুন। যে উগ্রপন্থী সেটলাররা দাঙ্গা ছাড়া কিছুই বোঝে না, তাদেরকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।