জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

0

সাত্বিক চাকমা

২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই অভ্যুত্থান আর একবার প্রমাণ করেছে এক্যবদ্ধ জনতার শক্তির কাছে বলদর্পী গণবিরোধী ফ্যাসিস্টরা কত অসহায়। পতনের আগ পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকারকে অনেক শক্তিশালী ও অপরাজেয় মনে হয়েছিল। কিন্তু জনগণের উত্থানে তার সরকার তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়েছে।

 জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চিত্র। সংগৃহিত ছবি

আজ ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকার নেই, কিন্তু তার স্থান দখল করেছে ড. ইউনূসের নব্য ফ্যাসিবাদ। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো আওয়ামী ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছিল, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হলেও, ফ্যাসিবাদের উৎসের মুলোৎপাটন হয়নি। সে কারণে এত বড় একটি অভ্যুত্থানের পরও বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যের মৌলিক কোন পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু অন্তর্বর্তী ইউনূস সরকারও হাসিনার ফ্যাসিস্ট আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। এক ফ্যাসিবাদী শাসনের বদলে আর এক ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হয়েছে।

ইউনূস সরকার যে হাসিনার ফ্যাসিস্ট নীতি অনুসরণ করে চলেছে তা বিশেষভাবে স্পষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার যে নীতি ছিল, ড. ইউনূস তা দাড়ি-কমাসহ বহাল রেখেছেন। তাই অভ্যুত্থানের পর দেশের সমতল অঞ্চলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের চর্চা বৃদ্ধি পেলেও, পাহাড়ে আজও তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এখানে সামরিক শাসন ও নিয়ন্ত্রণ পূর্বের মতোই বলবৎ রয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে আয়োজিত সভা সমাবেশ ভণ্ডুল করে দিতে সেনাশাসক গোষ্ঠী ইসলামিক উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মাঠে নামিয়ে দেয়। হাসিনার আমলে সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে মুখোশ বাহিনী কেবল অক্ষত নয়, তারা আগের মতোই সেনা পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রিয়াশীল রয়েছে। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীর সদস্যরা এখন নিজেরাই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। গতকাল খাগড়াছড়ির গুইমারায় জনতার ওপর সশস্ত্র গুণ্ডাদের হামলার ও তার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের ঘটনায় তা প্রমাণিত হয়েছে। যে জনসংহতি সমিতি ছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর ও অভ্যত্থানের সময় তার পক্ষে কাজ করেছিল, সেই জনসংহতি সমিতি এখনও আঞ্চলিক পরিষদে বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং সেনাবাহিনীর বি-টিম হয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া ইউপিডিএফের ওপর হাসিনা সরকারের মতো ইউনূসের আমলেও একই কায়দায় দমনপীড়ন অব্যাহত রয়েছে।

সেনাবাহিনীর অন্যায়-অবিচারের বিরদ্ধে গুইমারার কালাপানিতে জনতার প্রতিরোধ চিত্র।
ছবিটি ভিডিও থেকে নেওয়।

অবশ্য গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর এখন পাহাড়ের চেয়ে সমতলের অবস্থা যে খুব বেশি ভালো তাও বলা যাবে না। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি যথার্থই বলেছে, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরের এক বছরে হাসিনার সরকারকে ফিরিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার।” (৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫) বিচার বহির্ভুত শ্রমিক হত্যা, ধর্মীয় অবমাননার অপবাদ দিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা সভা মব সন্ত্রাস করে বানচাল করে দেয়া, গণগ্রেফতার ও পাইকারী মামলা, সমতলের জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমি বেদখল, হিন্দুদের ওপর হামলা, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা – এসব আগের মতোই চলছে। এর সাথে ড. ইউনূস সরকার যোগ করেছে মবোক্রেসির মাধ্যমে নিরীহ নাগরিক হত্যা।

গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল সমাজে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করা। কিন্তু সেই লক্ষ্যের দিকে সরকার হাঁটছে না। অভ্যুত্থানে সকল শ্রেণীর, সকল স্তরের ও সকল জাতিসত্তার নারী পুরুষ সমানভাবে অংশ নিলেও, তার সুফল পাচ্ছে কেবল ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী উগ্র ডানপন্থী দলগুলো।  সে কারণে আমরা দেখি একদিকে সাজাপ্রাপ্ত ইসলামী জঙ্গীরা জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর জামিন অধিকারকে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, অন্যদিকে বম নারী-পুরষ-শিশুরা বিনা অপরাধে কারাগারের ভেতরে ডুঁকে ডুঁকে মরছে।

কাজেই ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান এখন একটি অসমাপ্ত প্রজেক্ট। এই প্রজেক্ট সম্পন্ন করার দায়িত্ব এখন বর্তেছে দেশের প্রকৃত গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও বিপ্লবী শক্তির ওপর। ফ্যাসিজমকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে হলে এই শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং ধর্মীয় মৌলবাদী ও ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের ফসল চূড়ান্তভাবে তাদের ঘরে তুলতে এই গোষ্ঠীটি  এখন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তারা দেশের যে আরও বারটা বাজাবে তা জনগণ জানে।

তাই দেরী না করে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ফ্যাসিবাদের মুলোৎপাত করার জন্য আন্দোলনে নেমে পড়তে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ এই আন্দোলনে সামিল হতে প্রস্তুত রয়েছে। পাহাড় ও সমতলে একসাথে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে আবার ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশের শোষিত নিপীড়িত শ্রেণী, জনগণ ও জাতিসত্তাগুলোর মুক্তির জন্য আর অন্য কোন পথ নেই। #



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More