স্কুল ঘরের জীবন- অপ্সরী চাকমা

আমার নাম অপ্সরী চাকমা। খাগড়াছড়ি জেলাধীন দীঘিনালা উপজেলার দীঘিনালা ইউনিয়নের ২নং বাঘাইছড়ির যত্ন কুমার কার্বারী পাড়ায় আমার জন্ম। আমার বয়স ১৬ বছর। মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমার বয়স ১৬ বছর হলেও বর্তমানে মনে করি আমি ৭০-৮০ বছরের মেয়ে। কারন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে যা কিছু দেখেনি তা বাস্তবে আমি দেখেছি। হয়তবা আমার ১৬ বছরের বয়সের কাহিনী শুনে অবাক হবে। কেউ কেউ মনে করবে গল্পের কাহিনী।
আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন ঘুমপাড়ানি হিসেবে রূপকথার নানান গল্প মা আমাকে শুনাত। অনুভব করতাম।রূপকথার পরী রানীর ছিল খুব সুখ, শান্তি। তবে রূপকথার পরী রানীর জীবনের বিপরীত হচ্ছে আমার জীবন। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম জানতামনা কোন দেশে, কোন জাতিতে আমার জন্ম ? কতটুকু আমার জন্য দেশের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত? পর্যায়ক্রমে যখন বুঝলাম জাতিতে আমি চাকমা, আমাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ঐতিহ্য অােছ।
যতন কুমার কার্বারী পাড়া ও সন্তোষ কুমার কার্বারী পাড়া ছোট ছোট হলেও কাছাকাছি দুটি গ্রাম। দু’পাড়ার লোকজন ছিল শান্ত সহজ। বাগানে গাছ গাছালির সুনিবিড়ে ঢাকা আমাদের এই দুই গ্রাম। প্রতিবেশীদের মধ্যে ছিল সদ্ভাব। একে অপরের পরিপূরক।
কিন্তু এই শান্ত সুনিবিড় গ্রামে গত ১৪ মে ২০১৪ ই্ং রোজ বুধবার ভোর ৩.০০ ঘটিকায় বিজিবি (বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) এই দুই গ্রামে আমাদের বাসস্থান ও ২৯ একর ভিটে মাটি দখলের উদ্দেশ্যে চলে আসে। আর তখন থেকে শুরু হয় আমাদের কষ্টের জীবন। দু’পাড়ার ২১ টি সহজ সরল নিরীহ পরিবার ৮৪ জন জনের জীবনে ছড়িয়ে পড়ে কালনাগিনীর বিষ। আমাদের সকলের চোখ থেকে ত্যাগ করলো ঘুম। আর মুখ থেকে হারিয়ে গেল আমাদের সকলের হাসি। যে পাড়ার মানুষ সুখে বাচঁতে চেয়েছিল, সে মানুষ এখন নিরবে কাঁদে।
বিজিবিরা যে দিন এসেছিল সেদিন হতে তারা আমাদের নানা বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে ভয় দেখাতো। রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়তাম তখন বিজিবিরা হইচই শুরু করত। মাঝে মাঝে আমাদের ঘরের উঠোনে রাতে এসে বসে থাকত। যার ফলে রাতে প্রাকৃতিক কাজে বাইরে যাওয়ারও সাহস হতোনা।
ভয় করত যে তারা আমাদের পেলে ধরবে নাতো?? নাকি আমাদের গলা টিপে হত্যা করবে? আর এভাবেই নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আমরা পাহাড়িরা, আমরা পাহাড়ি নারীরা আতংকে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। প্রায়ই শুনি পাহাড়ি নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বাঙালিরা করছে নিরাপত্তা বাহিনীরা করছে শুনে ভয়ে মরে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার মা, বোনের জীবনের উদাহারন।
বিজিবির আসার পর থেকেই আমাদের স্বাভাবিক জীবন শেষ হয়ে যায়। আমরা যখন গোসল করতে কুয়ার ঘাটে যেতাম, বিজিবিরা আমাদের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকত। নানারকম অংগ-ভংগী করতো। খারাপ খারাপ কথা বলত। তুবও আমরা চুপ মেরে আমাদের গ্রামে ছিলাম।
আর এভাবে যেতে না যেতেই ২২ মে ২০১৪ ইং রোজ বৃহষ্পতিবার নিরাপত্তার নাম দিয়ে চেকপোষ্ট বসায় এবং রীতিমত চেকপোষ্টে বিভিন্ন সময় বিরুক্তি কর প্রশ্ন করত। তুমি কি কর? বাবার নাম কি? কয় ভাই বোন ইত্যাদি। তবুও নিরবে সহ্য করেছিল দুপাড়ার মানুষ। কিন্তু ১০ জুন ২০১৪ ইং রোজ মংগলবার দুপুর ২.০০ ঘটিকায় বিজিবিরা ইচ্ছা মত আমার বাবার লাগানো কলা গাছ কেটে দেয় এবং তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে গেলে সেদিন পরিকল্পিত ভাবে বাবুছড়া পুরান বাজার গুচ্ছগ্রাম থেকে মো:মজিব ইসলাম, মো: মালেক ইসলাম ও মো:শরিফউল ইসলামের নেতৃত্বে একদল সেটলার গিয়ে বিজিবি পুলিশ ও সেটলার বাঙ্গালিরা যৌথভাবে হামলা চালায়। পুলিশ সেখান আগে থেকে নিরাপত্তার নামে বিজিবির সাথে ছিল। সে হামলায় দু’পাড়ায় নারী পুরুষসহ ২২ জন আহত হয়। তারপর ঘটনাস্থলে সেদিন উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা স্বচক্ষে দীঘিনালা হাসপাতালে ১৮ জন ও খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ৪ জন ভর্তি করা হয়। সেখানে আমিও একজন রোগী হিসেবে ছিলাম।
১১জুন ২০১৪ইং রোজ বুধবার বিভিন্ন জেলা উপজেলার জনপ্রতিনিধিরা খাগড়াছড়ি হাসপাতালে আমাদের ৪জন নারীর সাথে দেখা করতে যায়। আমরা প্রশাসনের কাছে বিচারের প্রত্যাশায় ছিলাম। কিন্তু বিজিবির বিরুদ্ধে যখন মামলা করতে প্রশাসনের কাছে যায় তখন মামলা নেয়নি। প্রশাসন বলেছিল সরকারী বাহিনীর উপর মামলা করা যায়না। কিন্তু বিজিবিরা উল্টো করে আমাদের ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানী মামলা দেয়।
১৩ জুন২০১৪ ইং শুক্রবার২.৩০মিনিটে খাগড়াছড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের ৪ জন ও দিঘীনালা থেকে আমাদের দেখতে আসা দুই জন পুরুষ সহ মোট ৬ জন লোক হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করে। ১৪ জুন ২০১৪ ইং, শনিবার স্নেহ কুমার চাকমা ও প্রদীপ চাকমাকে জেল হাজতে নিয়ে যায়। আর ১৫জুন তারিখে তাদেরকে কোর্টে তুলে। ম্যাজিষ্ট্রেট স্নেহ কুমার চাকমাকে জামিন প্রদান করে।
তারপর ১৬জুন ২০১৪ইং আমাদেরকে অর্থ্যাৎ আমাদের ৪ নারীকে কোর্টে তুলে। এখানে উল্লেখ করা দরকার এই ৪ নারীর একজন আমার মা, আরেকজন আমার মায়ের মাসী অর্থ্যাৎ আমার নানু, আরো একজন গ্রামবাসী এবং আমি। আমরা সবাই মাথায় আঘাত প্রাপ্ত ছিলাম। আমার মা বাদে। মায়ের হাত ভেঙ্গে গেছে বিজিবির আঘাতে। আমাদের সকলের মাথায় ৪-৭ করে সেলাই পড়েছিল। রক্তক্ষরণে শারীরিক আর মানসিক কষ্টে আমরা সকলেই খুব ক্লান্ত ছিলাম। কোর্টে যখন তোলা হলো আমরা দাড়াঁতেই পারছিলামনা। সবাই ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে মাটিতে বসে পড়েছিলাম। ম্যাজিষ্ট্রেট শুধু আমার মাকে জামিন প্রদান করে। আমি ভেবেছিলাম আমি জামিন পাবো কারন আমিতো বয়সে ছোট। কিন্তু শুধুমাত্র মাকে জামিন দিয়ে আমাদেরকে জেল এ পাঠানো হয়। সেদিনই আবার এই মামলার আসামী স্বেচ্ছায় স্যারেন্ডার করতে আসা ৩ জনকে জেল হাজতে পাঠানো হয়। তো আমরা এই ঘটনায় মোট ৭ জন এখন জেলে।
২২জুন ২০১৪ ইং, সপ্তাহ খানেক পর আমাকে খাগড়াছড়ি জেল থেকে চালান করে হাটাহাজারিতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২৯জুন আবার খাগড়াছড়িতে আনা হয় এবং সেদিন থানায় রাখা হয়। পরদিন ৩০ জুন আমাকে কোর্টে তুলবে। সেদিনও ভেবেছিলাম আজ আমার অবশ্যই জামিন হবে। কিন্তু হয়নি। অনেকদিন পর নানু আর মায়ের সাথে দেখা হল। যেহেতু জামিন হয়নি তাই আবার আমাকে হাটাহাজারিতে নিয়ে গেলো। এরপরে আমার জামিন হয় ৫জুলাই ২০১৪ইং এবং আমি হাটাহাজারী জেল থেকে মুক্তি পাই ৭ জুলাই। পরদিন দীঘিনালা এসে আমার খুব মন খারাপ লাগল।
দীঘিনালায় এসে প্রথম আমার মনে প্রশ্ন এলো এখন কোথায় যাবো? বাড়িটা বিজিবিরা বেদখল করে রেখেছে। আমরা এখন আর আমাদের গ্রামে আমাদের বাড়ীতে যেতে পারিনা। খুব মন খারাপ করে বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আসলাম যেখানে আমার মা বাবা আর গ্রামের সবাই আছে। সেখানে এসে সবাইয়ের দেখা পেলাম। মায়ের হাতটা ব্যান্ডেজ করা। হাতের অপারেশন করতে হয়েছিল। জেলে গেছি নিজ বাড়ী থেকে। আমাকে এসে উঠতে হলো ২ কামরার স্কুল ঘরে।
আজ অনেক দিন হয়ে গেল আমরা এখনো আমাদের বাড়ীঘরে ফেরত যেতে পারিনি। কত কিছু করছি তাও না। এভাবে রীতিমতো হতাশ হয়ে যায় যে, বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আর কতদিন মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে। ছোট ছোট বাচ্চাদের কি হবে ? তারা কি আর লেখাপড়া করতে পারবে না? প্রায়তো সরকারী মহল থেকে এখানে তদন্ত করতে আসে । রির্পোট নিয়ে যায় এবং ছবি তুলে। এভাবে সিএইচটি কমিশন ৩জুলাই আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল। ১৪ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিশন ঘটনার স্থান পরিদর্শন ও আমাদের সাথে কথা বলেছিল। কিন্তু সবাই আশার বানী শুনিয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে কিছুই তো হয়নি। হায় ভগবান আমাদের অপরাধটা কি!! আমরা কি এদেশের নাগরিক নয়?
আমাদের কি কোন অধিকার নেই? কেনবা সরকার আমাদের এভাবে নির্যাতন করছে? কোথায় গেলে বিচার পাব? কোথায় হবে আমাদের বাচাঁর ঠিকানা??
আমার খুব মন খারাপ লাগছে।#
লেখক: অপ্সরী চাকমা, ১ম বর্ষ, দীঘিনালা ডিগ্রী কলেজ, খাগড়াছড়ি।
সৌজন্যে: ঠোটকাটা.নেট