কাউখালি (রাঙামাটি)॥ ভিক্ষু সংঘের শীর্ষ নেতা ও রাঙামাটির রাজ বনবিহারের অন্যতম জ্যেষ্ঠ ভিক্ষু শ্রীমৎ জ্ঞানপ্রিয় মহাস্থবির বলেছেন, ‘জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে নব্য মুখোশ বাহিনী কেন কোন অপশক্তি টিকতে পারবে না।’
আজ রবিবার (২৪ ডিসেম্বর ২০১৭) কাউখালির ডেবাছড়িতে সেনাবাহিনীর লেলিয়ে দেয়া নব্য মুখোশ বাহিনী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত শহীদ ইউপিডিএফ সংগঠক অনল বিকাশ চাকমা প্লুটোর স্মরণে আয়োজিত শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ও গণ শোক সভায় তিনি এ কথা বলেন।
উক্ত অনুষ্ঠানের ব্যানারের মূল শ্লোগান ছিল ‘দেশ ও জাতির জন্য যারা আত্মোৎসর্গ করেন তারা বীর, তাদের স্মৃতি চির অম্লান; খুনী, বিশ্বাসঘাতকরা ইতরপ্রাণী-তুল্য, হীন ও ঘৃণ্য; তারা একদিন বিনাশ হবেই।’
অনল বিকাশ চাকমা প্লুটোর পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও ইউপিডিএফের কাউখালি ইউনিট যৌথভাবে এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ও গণ শোক সভার আয়োজন করে।
তিনি বলেন, ‘একটি জাতির টিকে থাকা ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য তিনটি ছায়া দরকার। রাজার ছায়া, বুদ্ধের ছায়া ও জ্ঞাতির ছায়া। রাজনৈতিক দলও ছায়ার মতো।’
কোন দল বা জাতির উন্নতির জন্য চারটি শক্তি দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন এবং বলেন, জ্ঞান শক্তি দিয়েই নব্য মুখোশ বাহিনীকে মোকাবিলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঐক্যের কোন বিকল্প নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন একটি নাটক চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘একটি নাটকে বিভিন্ন অঙ্ক, দৃশ্য ও পর্ব থাকে। বর্তমানে যে পর্ব চলছে তারও শেষ আছে। তাই সবার ধৈর্য্য ও সাহস রাখতে হবে।’
তিনি বলেন সৎ চিন্তা ও সৎ জ্ঞানের অধিকারী এবং ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, তাহলে নব্য মুখোশ বাহিনী কেন কোন অপশক্তি টিকতে পারবে না।
পরম পূজনীয় আর্য শ্রাবক বনভান্তের উদ্ধৃতি দিয়ে জ্ঞানপ্রিয় ভান্তে বলেন, ‘ন্যায় অন্যায়ের বিচার আছে। অন্যায় করলে তার শাস্তি আর ন্যায় করলে তার সুফল আছে।’
রাঙামাটির নানিয়াচর রত্নাঙ্কুর বন বিহারের অধ্যক্ষ ও বন ভিক্ষু সংঘের অন্যতম শীর্ষ শ্রাবক শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির সেনা-সৃষ্ট বর্মা-তরুর নেতৃত্বাধীন নব্য মুখোশ বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কঠোর সমালোচনা করে দেশনা দেন। তিনি বলেন নব্য মুখোশ বাহিনীর সদস্যরা ‘জাত বিরোধী ও ধর্ম বিরোধী, তাই তাদের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
উক্ত অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় বিশুদ্ধানন্দ ভান্তে আরো বলেন, নব্য মুখোশ বাহিনীর সর্দার বর্মা ‘নীতিচ্যুত বলে ইউপিডিএফে টিকতে পারেনি, সংস্কারেও (জেএসএস এম. এন. লারমা) টিকতে পারেনি। পরে সে আর্মিদের সহযোগিতায় নান্যাচরে এসেছে।’
পার্টি করতে নীতি আদর্শ দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বর্মার তা নেই। সে কেবল চাঁদা চাইছে, লোকজনকে হুমকি দিচ্ছে, মানুষ ধরছে ও মারছে। এ থেকে বোঝা যায় সে কোন লেভেলের লোক।’
তিনি বলেন, ‘রাজনীতির কাজ হলো ভূমি রক্ষা করা, জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা করা, জনগণের জন্য ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু বর্মা এ সবের মধ্যে নেই। তার কোন বোধ শক্তিই নেই, সে পাগলের মতো আবোল তাবোল বকছে।’
অনুষ্ঠানে ফুরমোন আন্তর্জাতিক ভাবনা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ ভৃগু মহাস্থবির বলেন, ‘বনবিহারের অধীনে ৭০০ জনের মতো ভিক্ষু ও শ্রমন রয়েছেন। জনগণের জন্য এটা একটা শক্তি।’
তিনি ‘বালু পেগের’ (এক ধরনের পাখি) উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘এই পাখিরা গাছের শাখায় ওঁৎ পেতে থেকে শিকার ধরে। ঠিক সেভাবে কোন কোন নারী ভিক্ষু, শ্রমন ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ধরে ফেলে। এতে তারা নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়।’
তিনি বলেন ‘প্লুটো শহীদ হওয়ার আগে তার বাড়িতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেছিলেন। তিনি ন্যায়ের পথে থেকে আন্দোলন করেছিলেন। তাকে মেরে ফেলে বর্মারা একটি বিশেষ মহলের কাজটিই করে দিয়েছে।’
ইউপিডিএফ রাঙামাটি জেলা ইউনিটের সংগঠক শান্তিদেব চাকমা নব্য মুখোশ বাহিনী সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এদের কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য আদর্শ ও কর্মসুচি নেই। তারা রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত। বর্মরা বলে তারা নাকি নিজেরা বাঁচার জন্য বাধ্য হয়ে দল গঠন করেছে, কিন্তু দুনিয়ায় কোন নজির নেই কেউ নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে বাঁচার জন্য পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছে। তদের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ইউপিডিএফ-কে ধ্বংস করা। কিন্তু কোন একটি বিশেষ পার্টিকে ধ্বংস করতে কোন কালে কোন দেশে পার্টি গঠিত হয়নি। পার্টি গঠন করা হয় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। যারা পার্টি গঠন করেন তারা জনগণের মুক্তির মধ্যেই নিজেদের মুক্তি দেখতে পান। অথচ নব্য মুখোশ বর্মারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা জনগণকে মেরে শেষ করে নিজেরা বাঁচতে চাইছে।’
কিন্তু জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মুখে তারা টিকতে পারবে না বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা এমন কিছু করবেন না যাতে নব্য মুখোশ বাহিনীর সন্ত্রাসীরা সাহস, উৎসাহ ও শক্তি পেয়ে যায়, আর অপরদিকে পার্টি ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পার্টি ও জনগণের মধ্যেকার ঐক্য-সংহতি দুর্বল হয়।’
লক্ষীছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা অধূনা-লুপ্ত সেনা-সৃষ্ট বোরকা পার্টির বিরুদ্ধে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, সেনাবাহিনীর আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়েও এরা টিকতে পারেনি। নব্য মুখোশরাও টিকতে পারবে না।
পার্টি ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করলে যে কোন অপশক্তিকে যে পরাজিত করা যায়, লক্ষীছড়িতে বোরকাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে।
কাউখালি উপজেলা পষিদের ভাইস চেয়ারম্যান মংসুইউ মারমা (দুঅং) বলেন, অপরিণত বয়সে প্লুটোর মৃত্যু বেদনাদায়ক। তিনি দেশ জাতির জন্য কাজ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। তাই তিনি অমর হয়ে থাকবেন।
নান্যাচর সদর ইউপির মেম্বার অনিতা চাকমা সম্প্রতি বর্মার সাথে তার সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘সে আমাকে ও নান্যাচরে নির্বাচিত অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের ডেকে চরমভাবে অপমানিত ও হেনস্থা করেছে। সে এখন পাগলের মতো আচরণ করছে। সে আমাদেরকে যা করেছে মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন কেউ তা করতে পারে না। তাকে চেনার আর বাকি নেই।’
অনুষ্ঠানে এছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন কাউখালি উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কৃপা চাকমা, ফটিকছড়ি ইউপির চেয়ারম্যান ধন কুমার চাকমা, ঘাগড়া ইউপির চেয়ারম্যন জগদীশ চাকমা ও প্রবিল চাকমাসহ লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার সকল ইউপি চেয়ারম্যান।
এছাড়া বিভিন্ন বিহারের ৪০ জনের মতো ভিক্ষু উপস্থিত ছিলেন।
পুরো অনুষ্ঠানকে দুই পর্বে ভাগ করা হয়। প্রথম পর্বে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা। অনুষ্ঠানের শুরুতে শহীদ প্লুটোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন রূপসী চাকমা। এরপর তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শ্রীমৎ জ্ঞানপ্রিয় মহাস্থবিরের নেতৃত্বে ৩ মিনিট ভাবনা করা হয়।
অনুষ্ঠানে এলাকার হাজার হাজার নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ইউপি সদস্য অনিল কান্তি চাকমা ও থুইক্যচিং মারমা।
————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।