সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে এবং বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ
নিজস্ব প্রতিবেদক, সিএইচটিনিউজ.কম
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে এবং বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় আজ ৭ ডিসেম্বর, বুধবারবিক্ষোভমিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে, খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের বাধার কারণে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। সকাল থেকে সেনাবাহিনী গ্রামে গ্রামে ঢুকে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং লোকজনকে সমাবেশ স্থলে যেতে বাধা দেয়।
গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে অবিলম্বে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী বাতিল, দেশের সকল সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে।
রাঙামাটি : জেলা সদরের কুদুকছড়িতে দুপুর ১২টায় বড় মহাপুরম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারের সামনে ইউপিডিএফ-কুদুকছড়ি ইউনিটের সংগঠক জ্ঞান বিকাশ চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য টিটু বিকাশ চাকমা, কুদুকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু বিকাশ চাকমা, সাপছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিমুল বিকাশ চাকমা, বুড়িঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রমোদ খীসা, কুদুকছড়ি মৌজার হেডম্যান সম্রাটসুর চাকমা, কুদুকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান প্রভা রঞ্জন চাকমা, কুদুকছড়ি ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার উদয় কিরণ চাকমা ও কুদুকছড়ি এলাকার বিশিষ্ট মুরুব্বী অমলেন্দু চাকমা। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল কুদুকছড়ি বাজার প্রদক্ষিণ করে।
খাগড়াছড়ি : জেলা সদরের মহাজন পাড়া থেকে দুপুর ২টায় একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে চেঙ্গী স্কোয়ার ঘুরে স্বনির্ভর বাজারে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে ইউপিডিএফ কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অর্পন চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক উমেশ চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার তথ্য ও প্রচার সম্পাদক রিনা চাকমা।
মহালছড়ি : খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে দুপুর ১:৩০টায় মহালছড়ি কলেজ মাঠে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের মহালছড়ি থানা শাখার সভাপতি সর্বানন্দ চাকমা। এতে অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মহালছড়ি থানা শাখার সভাপতি ম্যাজিক দেওয়ান, সাধারণ সম্পাদক রতন স্মৃতি চাকমা, মহালছড়ি কলেজ শাখার সভাপতি জনি মারমা ও মহালছড়ি কলেজের ছাত্রী বিশাখা চাকমা। সমাবেশ শেষে কলেজ মাঠ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে মহালছড়ি বাজার প্রদক্ষিণ করে।
গুইমারা : খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারার রামেসু বাজারে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি আপ্রুসি মারমা, গুইমারা থানা শাখার আহ্বায়ক অংকন চাকমা ও গুইমারা হাইস্কুল শাখার আহ্বায়ক চিত্রজ্যোতি চাকমা বক্তব্য রাখেন। সকাল থেকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বিভিন্ন স্থানে জনগণকে সমাবেশে জড়ো হতে বাধা দিয়েছে। তারা বাল্যাছড়ি, গুইমারা বাজার এবং হাসপাতাল এলাকা থেকে সমাবেশ আগত লোকজনকে তাড়িয়ে দেয়।
এছাড়া রাঙামাটি জেলার কাউখালী ও খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতেও বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উপরোক্ত সমাবেশ সমূহতে বক্তরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশের ভিন্ন ভাষা-ভাষী জাতি ও সম্প্রদায়সহ গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের তীব্র আপত্তি ও প্রতিবাদ সম্পূর্ণ উপো করে মতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ৩০ জুন সংসদে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের ভিন্ন ভাষা-ভাষীর জাতি ও সম্প্রদায়কে আওয়ামী লীগ সরকার পুরোপুরি অস্বীকার করে সবার জাতীয়তা বাঙালি বলে চাপিয়ে দিয়েছে।
বক্তারা আরো বলেন, বিগত সংসদ নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের মতামতের প্রতি মোটেও শ্রদ্ধাশীল নয়। ফ্যাসিস্ট কায়দায় জনমত তোয়াক্কা না করে জোরজবরদস্তিমূলকভাবে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ রার্থে নানাবিধ আইন বিধি প্রণয়ন করছে। জনগণের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ৫-১০ ডিসেম্বর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র উৎসবের নামে ঢাকায় ইউএনডিপি‘র অর্থায়নে অনুষ্ঠান করছে। পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসমূহকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বলে মিথ্যাচার করেছেন। ইউনেস্কো পুরস্কার প্রাপ্তি‘কে ‘পার্বত্য চুক্তি‘ বিশ্ব সমাদৃত ও সরকারি পদক্ষেপের স্বীকৃতি লাভ বলে তারা দাবি করেছেন।
বক্তারা বলেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ‘-এর মাধ্যমে অঘোষিত সেনা শাসন জারি রেখেছে। সংবিধানে স্বীকৃত শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ পর্যন্ত সরকার করতে দিচ্ছে না। নীল নঙ্ার মাধ্যমে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রেখেছে। ডিজিএফআই-এর মাধ্যমে জাতীয় বেঈমান সন্তু লারমা গ্রুপের নিকট অস্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। সন্তু লারমার ভাড়াটে খুনীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে বোঝাপড়া সাপেক্ষে সন্তু লারমা ঢাকার হোটেল সুন্দরবনে সংবাদ সম্মেলন, শহীদ মিনারে সমবেশ, ইন্ডিপেডেন্ট টিভি-মাছরাঙা টিভিসহ বেশ কিছু মিডিয়ায় প্রকাশ্য সাতকারে নিজেদের সশস্ত্র ক্যাডার তৎপর থাকার কথা স্বীকার করেছেন, তা সত্ত্বেও সরকার তার বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডে উস্কানিদান, উন্নয়নমূলক খাতে আঞ্চলিক পরিষদে বরাদ্দকৃত চাল-গমসহ বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের কারণে সন্তু লারমার বিরুদ্ধে কোন পদপেই নেয় নি।
বক্তারা অবিলম্বে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী বাতিল, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা, প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকতি, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে উস্কে দেয়ার ষড়যন্ত্র বন্ধ করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারপূর্বক সেনা শাসনের অবসান ও সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসনের জোর দাবি জানান।