নানিয়াচর॥ সম্প্রতি জেএসএস সংস্কারবাদী গ্রুপ থেকে একজন ও নব্য মুখোশ বাহিনী থেকে দুই জন তাদের আস্তানা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। গত ২২ এপ্রিল তারা সিএইচটি নিউজ ডটকমকে সাক্ষাতকার দেন। তাদের বক্তব্যের চুম্বক অংশ:
- আন্দোলন সংগ্রামের কোনো কথা-বার্তা সংস্কারবাদী গ্রুপ ও নব্য মুখোশ বাহিনীতে নেই, বরং যারা জুম্মদের স্বার্থে সংগ্রাম করতে চায় তাদের উপর সেনা সহায়তায় হত্যা-গুম, জেল-জুলুম, দমন-পীড়ন চালানোই তাদের কাজ।
- সংস্কার দলের সদস্যদের মধ্যে ইউপিডিএফ-র বিরুদ্ধে আর্মি, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য দেয়ার প্রতিযোগিতা চলে।
- গাঁজা-ইয়াবা-মদ এসব সেখানে ফ্রি। শক্তিমান মদ খেয়ে মাতলামি করে।
- শক্তিমান বলে: “তোমরা ইচ্ছামত মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে যাও, ইচ্ছামত বহু বিবাহ করে যাও, কোনো অসুবিধা নেই, আইনগত বিষয় সামাল দিতে আমিতো রয়েছি।”
- সংস্কারদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই খুবই তীব্র। কার দায়িত্ব কে কিভাবে কেড়ে নেবে সব সময় তার চক্রান্ত। সকলেই কালেক্টর হতে চায়। কারণ এ দলে কালেক্টরের ভাগে ‘ভিটামিন’ বেশী থাকে।
- চয়ন চাকমা নব্য মুখোশদের বলে: “চালিয়ে যাও ভেইলক, ইউপিডিএফ-কে শেষ করে দাও, আমরা তোমাদের পাশে আছি, তোমাদের যখন যা প্রয়োজন হবে আমরা তখন তা যোগান দিয়ে দেবো, কোনো দু:শ্চিন্তা করবে না।”
- যখন বুঝতে পারি এটা জুম্ম স্বার্থ রক্ষাকারী কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং জুম্ম ধ্বংসকারী একটি পাল, তখন চলে আসি।
নিচে তিন জনের পুরো বক্তব্য পড়ুন:
(১) মৃগ কান্তি চাকমা ওরফে রিপল (৩৩), পিতা: শুক্র কুমার চাকমা, মাতা: চন্দ্রতারা চাকমা, গ্রাম: চৌধুরীছড়া, ইউপি: ঘিলাছড়ি, উপজেলা: নান্যাচর, জেলা: রাঙামাটি। সংস্কারবাদী দল। ফিরে আসার তারিখ: ২১ এপ্রিল ২০১৮।
রূপমের মামাতো ভাই নিশানের খপ্পড়ে পড়ে ২০১৬ সালের শেষের দিকে আমি নান্যাচর উপজেলা সদরে সংস্কার দলে যোগ দিই। মনে করেছিলাম সেই দলটিও জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ইউপিডিএফ-র মত লড়াকু একটি সংগঠন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি ‘ফোক্কায়’। অধিকার আদায় সংক্রান্ত আন্দোলন সংগ্রামের কোনো কথা-বার্তা সেখানে তো বিন্দুবিসর্গ নেই-ই, বরং যারা জুম্মদের স্বার্থে সংগ্রাম করতে চায় তাদের উপর সেনা সহায়তায় হত্যা-গুম, জেল-জুলুম, দমন-পীড়ন চালানই তাদের রুটিন কাজ। আমাকেও অনেকবার বলা হয়েছিল আর্মিদের সাথে অপারেশনে গিয়ে ইউপিডিএফ সদস্যদের ধরার জন্য, কিন্তু আমি তা করি নি।
নান্যাচর সদর থেকে গতকাল পালিয়ে আসা আগ পর্যন্ত আমি যা দেখেছি ও বুঝেছি তা রীতিমত চরম হতাশাব্যঞ্জক ও ধিক্কারজনক। সংস্কার দলের প্রতিটি সদস্য ইউপিডিএফ-র বিরুদ্ধে কাজ করে ও তথ্য দিয়ে কে বেশী আর্মি, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে প্রশংসার পাত্র হতে পারবে তার তীব্র প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। নান্যাচরে মূলত শক্তিমান, প্রগতি ও রূপম এ তিনজনই আসল হোতা। আর্মি জোনের সাথে তাদের সার্বক্ষনিক যোগাযোগ। ইউপিডিএফ-র গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে কিঞ্চিত খবর পেলে তারা সঙ্গে সঙ্গে জোনে অবহিত করে এবং কিভাবে কি করতে হবে তার দিকনির্দেশনা দেয়। আর্মিরাও তাদের নির্দেশনা মত নড়েচড়ে উঠে এবং সংস্কার বা নব্যমুখোশ দলের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে সময়ে অসময়ে অপারেশনে বের হয়।
নব্যমুখোশদের ব্যাপারে শক্তিমান ও প্রগতি আমাদেরকে ব্রিফ করে যে, “তারা আলাদা নামে আবির্ভূত হলেও আমাদের সাথে তাদের কোনো ভিন্নতা নেই। কাজের সুবিধার্থে রাজনৈতিক কারণে সরাসরি জেএসএস(এমএন লারমা) নাম ব্যবহার না করে সুকৌশলে অন্য পরিচয়ে তাদেরকে মাঠে নামানো হয়েছে। তোমরা সবাই তাদেরকে সঙ্গী হিসাবে ধরে নিয়ে একসাথে মিলেমিশে থাকবে। বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতার কারণে যে কাজসমূহ আমরা প্রকাশ্যে করতে পারব না সেগুলি তাদেরকে দিয়েই করতে হবে। এটা রাজনৈতিক চাল, যে কেহ সহজে বুঝবে না।”
শক্তিমান আমাদের উদ্দেশ্যে একটা কথা বার বার বলতো, “বৈধ হোক বা অবৈধ হোক তোমরা ইচ্ছামত নারীর সাথে সম্পর্ক করে যাও, ইচ্ছামত বহুবিবাহ করে যাও, কোনো অসুবিধা নেই, আইনগত বিষয় সামাল দিতে আমিতো রয়েছি।”
ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যে যে জাতীয় চেতনাবোধ ছিল, গত দেড় বছর সংস্কার দলের সাথে থেকে তাও লোপ পেয়েছে। কারণ সেখানে জাতীয় চেতনাবোধের কোনো চর্চা নেই। যা নিয়মিত চর্চা হয় তা খুবই খারাপ। গাঁজা-ইয়াবা-মদ এসব সেখানে ফ্রি। শক্তিমানকে মদ খেয়ে মাতলামি করতে দেখে আমি রীতিমত হতবাক। তার ১৮টি বিদেশী গরু রয়েছে। সে দলীয় সদস্যদের দিয়ে ঐ গরুগুলির পরিচর্যা করে থাকে। অনেকটা গোয়ালার মত খাটানো হয় যা আমি নিজেও ভুক্তভুগী।
আর্মি, সংস্কার এবং মুখোশদের মধ্যে সম্পর্ক কিরূপ এমন প্রশ্নের জবাবে আমি মোটাদাগে শুধু একটি কথা বলতে চাই যে, তারা এখন শুধু নামেই আলাদা, অন্যসবক্ষেত্রে এক এবং অভিন্ন। তাদের সকলের লক্ষ্য হচ্ছে জুম্ম জাতির অনিষ্ট সাধন ও ইউপিডিএফ-কে ধ্বংস করা। সংস্কারদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই খুবই তীব্র। কার দায়িত্ব কে কিভাবে কেড়ে নিতে পারবে তার চক্রান্ত হরহামেশা। ক্ষমতার জন্য সবাই লালায়িত। সকলেই কালেক্টর হতে চায়। কারণ এ দলে কালেক্টরের ভাগে ‘ভিটামিন’ বেশী থাকে।
নব্যমুখোশদের জন্মদাতা হচ্ছে সংস্কার ও সেনা বাহিনী। তাদের নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা তাদের প্রভুদের (সেনা ও সংস্কার) মর্জি মাফিক চলে। সংস্কার ও সেনাদের মনজুগিয়ে না চললে তাদের লেজ সেখানেই খতম। আর সেনা বাহিনীরা চায় জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংস করতে। তাই তারা সবসময় জুম্ম ধ্বংসের একটা না একটা ছক দিয়েই থাকে যা বাস্তবায়ন করতে হয় সংস্কার ও নব্যমুখোশদের।
এহেন জঘন্য খেলা সব দেখে-শুনে পার্টি লেবাসধারী সেই সেনা গোয়ালে আবদ্ধপালে থাকতে আর বিবেক সায় দিচ্ছে না। তাই ঐ পালটির সঙ্গ ত্যাগ করে সমাজ জীবনে ফিরে এসেছি।
(২) ইন্টন চাকমা ওরফে সুরেন (৩৪), পিতা: হরিদাস চাকমা, গ্রাম: বাঘছড়িমুখ দেয়ান পাড়া, ইউপি: সাবেক্ষ্যং, উপজেলা: নান্যাচর, জেলা: রাঙামাটি। নব্যমুখোশ দল। ফিরে আসার তারিখ: ১৯ এপ্রিল ২০১৮।
বর্মা আমাদেরকে সবসময় আর্মিদের সঙ্গে ইউপিডিএফ-র বিরুদ্ধে অপারেশনে যেতে নির্দেশ দেয়। অপারগতা প্রকাশ করলে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে এবং গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। আমাকে একবার মারিশ্যা এলাকায় আর্মিদের সাথে অপারেশনে যেতে বাধ্য করা হয়। সেখানে অপারেশনের পর কোনোকিছু না পেয়ে বর্মা এবং আর্মিরা আমার উপর বেজার হয়ে আর্থিক সহায়তা কমিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়।
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ খুল্যাংপাড়া এলাকায় যে বন্দুক যুদ্ধ হয়েছিল তাতে আমাদের তিনটি হাতিয়ার নষ্ট হয়ে পড়ে। সংঘাতের দুইদিন পর সংস্কার দলের কোম্পানি কমান্ডার চয়ন চাকমা নিজে এসে ঐ নষ্ট হওয়া হাতিয়ারগুলির পরিবর্তে আরো তিনটি নতুন হাতিয়ার আমাদের হাতে তুলে দেয় এবং বলে যে, “চালিয়ে যাও ভেইলক, ইউপিডিএফ-কে শেষ করে দাও, আমরা তোমাদের পাশে আছি, তোমাদের যখন যা প্রয়োজন হবে আমরা তখন তা যোগান দিয়ে দেবো, কোনো দু:শ্চিন্তা করবে না।”
১৮ মার্চ ২০১৮ বর্মারা কুদুকছড়ি থেকে নারী অপহরন করতে আসার সময় তাদেরকে সরাসরি আর্মিরাই সড়ক ও নৌ দুই পথে নিয়ে এসেছিল। মোট কথা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আসা-যাওয়া, মুভমেন্ট, বিশ্রাম, নিরাপদ অবস্থান ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই আর্মিদের সাথে সমন্বয় রেখে ও তাদের সাহায্য নিয়েই করা হয়।
গুল্যাছড়ি এলাকায় একেবারে ইসলামপুর আর্মি ক্যাম্পের পাশেই আমরা সশস্ত্র অবস্থান করে থাকি। অস্ত্র ও লোকজন আনা-নেওয়ার কাজটি গোপনে আর্মিরাই করে দিয়ে থাকে। খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের মেজর আলী হায়দার বিষয়টি সরাসরি দেখাশুনা করে। মনে হয় এবিষয়ে সে উপরি মহল থেকে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত। সেনা বাহিনী মুখোশদের নিরাপত্তা বিধানে খুবই তৎপর।
(৩) তোষমুণি চাকমা ওরফে তোষণ (৩০), পিতা: সমীর কান্তি চাকমা, মাতা: বিনতা চাকমা, গ্রাম: সুরিদাস পাড়া, ইউপি: নান্যাচর, উপজেলা: নান্যাচর, জেলা: রাঙামাটি। নব্যমুখোশ দল। ফিরে আসার তারিখ: ১৮ এপ্রিল ২০১৮।
আমার আদি বাসস্থান বিলেইছড়ির ফকিরাছড়া। বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্রে ২০১৩ সালে সেখান থেকে নান্যাচরের বগাছড়িতে চলে আসি। সংস্কার দলের মনিষ চাকমা আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। তার বাড়ি মালছড়ির ইটছড়িতে। ফেব্রুয়ারি ২০১৮ দিকে আমি যখন খাগড়াছড়ি বেড়াতে যাই মূলত তখনই সে আমাকে প্রভাবিত করে মুখোশ দলে ঢুকিয়ে দেয়।
মনিষসহ সংস্কার দলের আরো কয়েকজন সদস্য যাদেরকে আমি চিনি না তারা বর্মা দলকে একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে আমার কাছে চিত্রায়িত করে। আমি তাদের কথা বিশ্বাস করে সেই নতুন রাজনৈতিক দলেই যোগ দিতে উৎসাহিত হই।
খাগড়াছড়ি থেকে আমাকে নান্যাচর সদরে আনা হয়। সেখানে সংস্কার দলের নেতা প্রগতি চাকমা আমার ইন্টারভিউ নেয় এবং ভর্তি করে নব্যমুখোশদের সাথে কাজ করতে বলে। সেই থেকে আমি তাদের হয়ে কাজ করি। পরে যখন বুঝতে পারলাম যে এটা জুম্ম স্বার্থ রক্ষাকারী কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং জুম্ম ধ্বংসকারী একটি অসৎ পাল, তাই কোনো বিবেকবান জুম্ম তাদের সঙ্গী হতে পারে না।#
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: দেবংশি ও সিদ্ধার্থ, ২২ এপ্রিল ২০১৮।
——————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।