॥ মন্তব্য প্রতিবেদন ॥
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি সাম্প্রতিক পাহাড়ধসের পেছনে ১৩ টি কারণকে চিহ্নিত করেছে। এই ১৩টি কারণের মধ্যে আটটি মানবসৃষ্ট এবং পাঁচটি প্রাকৃতিক। (দেখুন প্রথম আলো, ২৫ আগষ্ট ২০১৭ সংখ্যা) বৃহস্পতিবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে আছে নির্বিচারে বন ও গাছপালা ধ্বংস করা।
আরেকটি কারণ হলো পরিকল্পনার অভাব। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসতিস্থাপন, রাস্তা ও সড়ক নির্মাণ এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক স্থাপনা নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মানা।
উন্নয়নমূলক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। পাহাড়ে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব। মাটি পরীক্ষার ফলাফল যথাযথভাবে অনুসরণ না করে পুরোনো অ্যালাইনমেন্টের ওপর কাজ করা।
‘অপরিকল্পিত জুম চাষ। জুমচাষে আগাছানাশক ওষুধ ব্যবহার করার ফলে মাটি দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়া পাহাড়ের পরিবেশ-প্রতিবেশ অনুযায়ী ফসলাদি চাষ না করে আদা হলুদের চাষ করায় প্রচুর মাটি ক্ষয় হয়।
‘মানবসৃষ্ট অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ না লাগিয়ে বেশী লাভের আশায় অধিক হারে সেগুন গাছ লাগানো। পানি নিষ্কাশনের সুযোগ না রেখে উন্নয়নমূলক কাজ করা। পাহাড় থেকে বালু পাথর উত্তোলন।’
তদন্ত কমিটি পাহাড়ধসের ১৩টি কারণ চিহ্নিত করলেও তিনটি মূল কারণকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে তারা যে এগারটি সুপারিশ করেছে তা ভবিষ্যতে পাহাড় ধস রোধ করতে কোন কাজে আসবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উপেক্ষিত কারণগুলো হলো সমতল জেলা থেকে ব্যাপক হারে সেটলারদের আগমনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার নাটকীয় বৃদ্ধি, সেনাবাহিনীর তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি ও অন্যান্য কার্যক্রম এবং সরকারী প্রশাসনে দুর্নীতি। কারণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
১. জনসংখ্যার বৃদ্ধি : বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর দেশের সমতল জেলা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের অনুপ্রবেশের হার দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও, ১৯৭৯-৮৪ সালে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আনুমানিক এক লক্ষ বাঙালি পরিবারকে নিয়ে আসা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। তাদের আগমনের ফলে প্রকৃতি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। (সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াও) কারণ তারা সমতলে বাস করতে অভ্যস্ত কিন্তু পাহাড়ের জীবনযাত্রায় অনভ্যস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেও তারা সমতলের মতো জীবন ধারনোপযোগী চাষ-বাস পদ্ধতি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়, যা পাহাড়ি পরিবেশের সাথে আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারা পাহাড়ের বন জঙ্গল স্থায়ীভাবে সাফ করে চাষ শুরু করে। এভাবে প্রতি পরিবার যদি ৫ একর করে বন ধ্বংস করে তাহলে এক লক্ষ পরিবারের বসতির জন্য ৫ লক্ষ একর বন ধ্বংস করা হয়েছে। এর পরিবেশগত ফল হয় মারাত্মক।
জুম চাষকে পরিবেশের ক্ষতির জন্য দায়ী করা হলেও এই যে সেটলারদের জীবিকার জন্য স্থায়ীভাবে বন ধ্বংস করা হলো তা সাধারণত আলোচনায় নিয়ে আসা হয় না। অথচ জুম চাষ নানা কারণে বর্তমানে অলাভজনক হলেও এই চাষ পদ্ধতিতে স্থায়ীভাবে বন ধ্বংস হয় না।
জুম চাষের জন্য কাটা বন আবার সবুজে ভরে উঠে। কিন্তু সেটলাদের পাহাড়ে স্থায়ী চাষ পদ্ধতিতে তা হয় না। সেজন্য দেখা যায় কোন জুমচাষের এলাকায় ভূমি ধস হয়নি, হয়েছে সে সব এলাকায় সেখানে স্থায়ীভাবে বন ধ্বংস করা হয়েছে অথবা যেখানে চাষ অথবা বসবাসের জন্য পাহাড়ের গঠনে কাঠামোগত পরিবর্তন করা হয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি যে পাহাড়ধসের অন্যতম প্রধান কারণ তা স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় পাহাড় ধস মূলত: শহর এলাকাতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। আর শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হলো পার্বত্য চুক্তির পর সমতল এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালির আগমন। তারা স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় যত্রতত্র পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলে। তাই দেখা যায় রাঙামাটিসহ তিন জেলা শহরে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে মূলত নতুন বসতি এলাকায়।
২. কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি : পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি ও পর্যটন কার্যক্রম প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং তা সাম্প্রতিক ভূমিধসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির কৌশল অনুসারে রাস্তার দুপাশের কয়েক শ’ গজ এলাকার এবং প্রত্যেক ক্যাম্পের চারপাশের বিশাল এলাকার বন কেটে সাফ করে ফেলা হয়। আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের সড়কগুলোর দু’পাশে বটগাছ সহ বহু বড় বড় গাছ ছিল। কিন্তু ৮০-৯০ দশকে সেনাবাহিনী ওইসব গাছসহ রাস্তার দু’পাশের বন ও ঝোপঝাড় কেটে ফেলে। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে ভূমিধস হয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো সেনাবাহিনীর এই নির্বিচার বৃক্ষ নিধন। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে এর কোন উল্লেখ নেই।
সেনাবাহিনীর পর্যটন কার্যক্রমও বন উজার ও পরিবেশ ধ্বংসে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। যেমন সাজেক এক সময় ঘন ও গভীর বনে আচ্ছাদিত ছিল। কিন্তু ১০/১২ বছর আগে পর্যটনের জন্য সেনাবাহিনীর উদ্যোগে বাঘাইহাট থেকে রুইলুই পাহাড় পর্যন্ত পাকা রাস্তা নির্মাণের ফলে সেখানে ব্যবসায়ীদের বৃক্ষ আহরণের অপার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে কয়েক বছরের মধ্যে সাজেক এলাকা প্রায় বৃক্ষশুন্য হয়ে যায়। বন উজার হওয়ার কারণে এখন সেখানে জুমেও ভালো ফসল হচ্ছে না। প্রতিবছর খাদ্যভাব দেখা দিচ্ছে। এমনকি কয়েক মাস আগেও সরকারকে সাজেকে খাদ্যাভাব মোকাবিলার জন্য হেলিকপ্টারে করে ত্রাণ পাঠাতে হয়েছে। অথচ সাজেকের জুমে এক সময় এ অবস্থা ছিল না। নতুন পাকা রাস্তা হওয়ার আগে সেখানে জুমে প্রচুর ফলন হতো – এমনকি সারা বছর খেয়েও গোলার ধান ফুরাতো না। দুর্গম এলাকা হওয়ায় সে ধান বাজারেও বিক্রি করা সম্ভব হতো না।
বছরের পর বছর ধরে জুম চাষ করেও সাজেকে বন ধ্বংস হয়নি, অথচ পাকা রাস্তা হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই বন উজার হয়েছে। এখন যদি সেখানে কোন ভূমি ধস হয় তার জন্য দোষ দেয়া হবে জুম চাষকে – সেনাবাহিনীর রাস্তাঘাট নির্মাণ, পর্যটন কার্যক্রম ও মুনাফালোভী গাছ ব্যবসায়ীদের কেউ দোষ দেবে না। অথচ প্রকৃত অর্থে তারাই হলো আসল দোষী।
সত্যের খাতিরে এখানে আরো বলা দরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী এখন বিরাট Liability বা দায়। তাদের উপস্থিতি মাত্রও পরিবেশের জন্য হুমকি। কারণ আগেই বলা হয়েছে সেনা ক্যাম্পের চারপাশের বন কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নিয়মে সাবাড় করতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি ৫০০টি ক্যাম্প থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে কমপক্ষে ৫০০টি পাহাড়ের গাছপালা বন স্থায়ীভাবে ধ্বংস হয়েছে। কারণ সেনাবাহিনীর সব ক্যাম্প পাহাড়ের চুড়ায় বন ধ্বংস করে নির্মাণ করা হয়।
৩. প্রশাসনের দুর্নীতি : সাম্প্রতিক পাহাড় ধসের তৃতীয় যে প্রধান কারণটি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে অনুল্লেখিত রয়েছে সেটি হলো প্রশাসনের অভ্যন্তরে দুর্নীতি। সংবাদ মাধ্যমে ও বিভিন্ন আলোচনায় এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও রহস্যজনক কারণে প্রতিবেদনে তার কোন উল্লেখ করা হয়নি। এটা দুঃখজনক। পাহাড় ধসের প্রাকৃতিক ও অন্যান্য কারণ থাকলেও প্রশাসন কোনক্রমেই তার দায় এড়াতে পারে না। প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনের পর দিন পাহাড় কাটা হয়, কাপ্তাই লেকের পাড় অবৈধভাবে দখল করা হয়, বিল্ডিং কোড অমান্য করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়, অথচ প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে।
যদি শুরুতেই এইসব অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো, সমতল থেকে এসে অবৈধভাবে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরিয়ে দেয়া হতো, তাহলে অবশ্যই ভূমিধস রোধ করা যেতো, অথবা নিদেনপক্ষে ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ কমানো যেতো। ভূমিধসের পর প্রশাসন বলেছে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য সমতল এলাকা খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ে কি সমতল জায়গা আছে ? সুতরাং কাল বিলম্ব না করে সমতল থেকে আগত ক্ষতিগ্রস্ত সেটলার পরিবারগুলোকে সমতল জেলায় এবং স্থানীয় স্থায়ী আদি বাসিন্দাদেরকে পাহাড়ে পুনর্বাসন করতে হবে। এছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সম্পর্কে আরো একটি কথা বলা দরকার। এই প্রতিবেদনটি কেবল অসম্পূর্ণ তাই নয়, এটি পক্ষপাতমূলকও। কমিটি ভূমি ধসের জন্য জুমে আদা হলুদের চাষকেও দায়ি করতে ছাড়েনি, অথচ পাহাড়ের ঢালে বন উজার করে যে কচু ও তরমুজের ক্ষেত করা হয় তার উল্লেখ করেনি। তারা সেগুন বাগানকে দূষলেন, কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রাবার বাগানকে মওকুফ করলেন।
মোট কথা, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টে ভূমিধসের কতিপয় কারণকে সনাক্ত করা হলেও আসল ও গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোকে ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাশ কাটানো হয়েছে। সে কারণে তাদের এই রিপোর্ট সময় ও অর্থের অপচয় মাত্র এবং তা ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধস রোধ করতে কোন ভূমি রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। আর একটি কথা, প্রতিবেদনে পাহাড় ধসের জন্য প্রাকৃতিক কারণকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্যও হলো মূল কারণগুলোকে ধামাচাপা দেয়া। সত্য কথা হলো, প্রতিবেদনে অতিবৃষ্টিসহ যে পাঁচটি প্রাকৃতিক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো হলো বাহ্যিক কারণ। অভ্যন্তরীণ কারণ ছাড়া বাহ্যিক কারণ কোন বস্তুর পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে বলা যায়, উপরোল্লেখিত যে পাঁচটি প্রাকৃতিক কারণের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর বেশীর ভাগই সৃষ্টি এখানে আলোচিত তিনটি মূল কারণ কয়েক যুগ ধরে চলমান থাকার কারণে।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ধস রোধ করতে হলে অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি অবশ্যই জনসংখ্যা কমাতে হবে, অর্থাৎ সেটলারদেরকে সমতলে পুনর্বাসন করতে হবে, সেনাবাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার ও তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি সম্পর্কিত কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে এবং প্রশাসনের অভ্যন্তরে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে মহা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আশাকরি আমরা কেউ সেটা চাইনা। (সমাপ্ত)
—————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।