সংবিধানের বিতর্কিত ‘পঞ্চদশ সংশোধনী’র দশ বছর

চাপিয়ে দেওয়া বাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করতে হবে

0

বিশেষ প্রতিনিধি ।। আজ ৩০ জুন ২০২১ সংবিধানের বিতর্কিত ‘পঞ্চদশ সংশোধনী’র ১০ বছর পূর্ণ হলো। ২০১১ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসমূহের ওপর উগ্রবাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে তড়িঘড়ি করে সংসদে এই সংশোধনী পাস করে। এতে ষষ্ঠ অনুচ্ছেদের (২)-এ বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিতি হইবেন”। যদিও কারা জনগণ আর কারা নাগরিক কিংবা জনগণ ও নাগরিকের মধ্যে পার্থক্য কী তার কোন ব্যাখ্যা সরকার দেয়নি।

উক্ত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত দেশে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খিয়াং, ম্রো, খুমি, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, সান্তাল, গারো, মুনিপুরি, ওঁরাওসহ দেশে বসবাসরত ৪৫টির অধিক জাতিসত্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে।

স্মর্তব্য যে, সংবিধানের এই পঞ্চদশ সংশোধনী আনয়নের জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। সংসদে আইনটি পাসের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করে ইউপিডিএফ সংবিধান সংশোধনী কমিটির কাছে ৬ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছিল। এছাড়া দেশে বসবাসরত জাতিসত্তাসমূহের পক্ষ থেকেও নানা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার এসবের কোন গুরুত্ব দেয়নি।

এই পঞ্চদশ সংশোধনী আইনটি সংসদে পাস হয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে দেশে ব্যাপক বিতর্ক, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ইউপিডিএফের নেতৃত্বে লাল পতাকা মিছিল, তিন জেলা জুড়ে সর্ববৃহৎ ও দীর্ঘ মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, লাল কার্ড প্রদর্শন–ইত্যাদি নানা কর্মসূচি পালন করেছে এবং এখনো এ দাবিতে সোচ্চার রয়েছে। কিন্তু ১০ বছরেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এই সংশোধনী বাতিল বা সংশোধন করেনি। উপরন্তু সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে আগের চাইতেও নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেছে।

এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মুলত স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ এদেশে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিগুলোকে বাঙালি বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। যার কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধানেও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে “বাঙালি” হিসেবে অভিহিত করেছিল। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটি সফরে গিয়ে এক জনসমাবেশে পাহাড়িদেরকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।

তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ সংসদের ভেতরে ও বাইরে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদে দাঁড়িয়ে এর তীব্র  প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “মাননীয় স্পীকার, একজন বাঙালি কোনদিন চাকমা হতে পারে না, অনুরূপ একজন চাকমাও বাঙালি হতে পারে না’’ এই বলে তিনি প্রতিবাদ স্বরূপ সংসদ কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে তিনি ’৭২ সালে সংসদে গৃহিত সংবিধান আইনে স্বাক্ষর করেননি বলেও জানা যায়।

তবে পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রহিত করে তার পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করে।

এরপর আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ’৭২ এর সংবিধান পুনপ্রবর্তনের কথা বলে ২০১১ সালের ৩০ জুন পূনরায় সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত করে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে সংসদে ‘পঞ্চদশ সংশোধনী আইন’ পাস করে। এতে দেখা গেল, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এর প্রতিবাদ তো করেনইনি, বরং টেবিল চাপড়িয়ে এর সমর্থন জানিয়েছিলেন। যে দলিলে তাদেরকে ও তাদের নিজ নিজ জাতির জনগণকে বাঙালি বলে হেয় ও অবজ্ঞা করা হয়েছে সে দলিলে তারা বিনা দ্বিধায় স্বাক্ষর করেছেন! এটা জাতির জন্য বড়ই লজ্জার।

বিতর্কিত এই পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের জোরে সরকার ভবিষ্যতে দলিল-দস্তাবেজসহ সবখানে ভিন্ন ভাষাভাষি ও ধর্মীয় জাতিসত্তাগুলোকে বাঙালি পরিচয় দিতে জোরজবরদস্তি করবে না তার কোন নিশ্চিয়তা নেই।

তাই সংবিধানের এই বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল জাতিসত্তাসমূহের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উগ্রবাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধে আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে এবং লড়াই-সংগ্রাম জোরদার করতে হবে।

কর্মসূচি:

গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম আজ (৩০ জুন) সন্ধ্যায় “সংবিধানের সংখ্যালঘু জাতির বাঙালিকরণ, জাতিগত নিপীড়নের সাথে তার সম্পর্ক এবং মুক্তির লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনার আয়োজন করেছে।

এছাড়া বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল ও নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে তিন সংগঠনের (গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন) উদ্যোগে প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে বলে সংগঠনসূত্রে জানা গেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় তারা কর্মসূচি পালন করেছে।

আরও পড়ুন:

>> পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে ইউপিডিএফ যে দাবি জানিয়েছিলো


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More