মতামত

পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘বৈ-সা-বি’ শব্দের উৎপত্তির পটভূমি ও তার প্রাসঙ্গিকতা

0

কিরিটি অন্বেষা


(১)

ইদানিং কালে নানা মনগড়া কথা বলা হলেও “বৈ-সা-বি” এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান উৎসবের প্রতিশব্দ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তা হবার পেছনে কারণ ও ভিত্তি অবশ্যই আছে।

মূলতঃ লোগাঙ গণহত্যার (১০ এপ্রিল ১৯৯২) প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে পূর্ব নির্ধারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল, উৎসব বর্জন, মিছিল এবং প্রতিবাদ বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। রাঙ্গামাটি শহরে বিক্ষুব্ধ জনতা চৈত্রের প্রখর রৌদ্রে খালি পায়ে পিচঢালা রাজপথে নেমে আসে, অতীতে কখনও এমন দেখা যায় নি। জাতীয় পত্র-পত্রিকায় লোগাঙ গণহত্যার সাথে ‘বৈ-সা-বি’ শব্দটিও ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করে ও সাধারণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পায়।

খাগড়াছড়ি কলেজ মাঠে ‘বৈসাবি’ ১৩৯৮ (বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু) উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা [] ঢাকায় ফিরে গিয়ে ঘটনার প্রতিবাদ-নিন্দা জানিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দেন। সাংবাদিকরা প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরেন। জাতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিবৃতি ও প্রতিবেদনে ‘লোগাঙ গণহত্যা’ ও ‘বৈসাবি উৎসব’-এর সাথে দেশবাসী প্রথম বারের মতো পরিচিত হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। হিল লিটারেচার ফোরাম-এর ‘রাডার’ ম্যাগাজিনেও উক্ত ঘটনা নিয়ে বিশেষ সংকলন বেরিয়েছিল।

কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ‘বৈ-সা-বি’ কথাটির উদ্ভব হয় তারও আট বছর আগে ১৯৮৪ সালে। ঘটনাক্রমে সেটাও ছিল খাগড়াছড়ি কলেজ অঙ্গনে (প্রিন্সিপালের অফিসের পেছনে উত্তর-পূর্বের ফাঁকা জায়গাটিতে) এবং ফুল বিঝুর দিনে। উক্ত অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা ছিলেন খাগড়াছড়ি সদরের কতিপয় ছাত্র-যুবক [], যারা সে সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী । ঐ বছরই রাঙ্গামাটি কলেজ থেকে ‘বৈসাবি সংকলন’ নামে একটি প্রকাশনা বেরিয়েছিল। যার অগ্রণীরা ছিলেন কলেজের প্রথম বর্ষের কয়েক জন শিক্ষার্থী []। খাগড়াছড়ি কলেজে ‘বৈসাবি’ অনুষ্ঠান আয়োজন ও রাঙ্গামাটি কলেজে ‘বৈসাবি সংকলন’ প্রকাশের ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের মধ্যে পূর্ব যোগাযোগ বা আলোচনা সে ধরনের কিছু ছিল না। কেউ কারও উদ্যোগের বিষয়ে আগাম কোন কিছু জানতো না। আপতিকভাবে দু’টি স্থানের উদ্যোক্তাদের চিন্তা ও কাজে মিল ঘটেছে। সে সময়ে সমাজের বাস্তব পরিস্থিতিতে সচেতন ছাত্র-যুবকদের মাঝে ঐক্যের তাগিদ তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। এতে সাড়া দিয়ে কলেজপড়ুয়া কতিপয় ছাত্র ‘বৈসাবি’ নামে জাতিসত্তাসমূহের মাঝে ঐক্য গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়, চেতনার দিক থেকে সেটা ছিল অনেকটা বঙ্গ ভঙ্গের (১৯০৫) প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবিঠাকুর কর্তৃক সূচিত ‘রাখি বন্ধন’ আন্দোলনের মতোই।

লোগাঙ গণহত্যার প্রতিবাদ ও বৈসাবি বর্জন করে ‘সর্বস্তরের জনসাধারণ’ ব্যানারে মিছিল খাগড়াছড়ি কলেজের কড়ইতলা থেকে চেঙ্গি স্কোয়ারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। (১৩ এপ্রিল ১৯৯২)

দেশে এখন যেভাবে মহা সমারোহে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা (১৯৮৯ হতে) হয়ে থাকে, যার সূত্রপাত যশোরে ১৯৮৫ সালের পহেলা বৈশাখে। এ ধরনের উদ্যোগের ক্ষেত্রে ‘বৈসাবি’ অনুষ্ঠান আয়োজনকে অগ্রবর্তী বললে অত্যুক্তি হবে না। চেতনা ও লক্ষ্যের দিক থেকেও এর অনেকটা সাযুজ্য রয়েছে বলা চলে। স্বৈরাচার বিরোধী প্রতিবাদের চেতনা থেকেই পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা যশোর শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঢাকা এবং কোলকাতাতেও হচ্ছে। প্রথম দিকে তা ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। বাস্তবতার নিরিখেই তা পরিবর্তিত হয়েছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে। ব্যবসায়িক নানা ফন্দিফিকিরের কারণে কিছু ভিন্নমত থাকলেও এ অনুষ্ঠান বর্তমানে বাঙালি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে বলা চলে।

(২)

‘বৈসাবি’ নামের উৎপত্তির কারণ সন্ধান করতে হলে দৃষ্টি ফেরাতে হবে আশির দশকের পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির দিকে। সে সময় একদিকে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত ছিল তুঙ্গে, এতে খোদ এম.এন. লারমা প্রাণ হারান। লারমা গ্রুপ আর প্রীতিগ্রুপ-এর বিভেদের ছায়া পড়েছিল সমাজেও, যা ছিল অসহনীয়। অন্যদিকে স্বৈরশাসক এরশাদ পার্বত্য চট্টগ্রামের এ অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। আন্দোলন ধ্বংসের লক্ষ্যে ‘সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দিয়ে ‘ভাগ করে শাসন’ চালানোর নীতি জোরদার হয়। এরশাদ সরকার সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বিদ্বেষ উস্কে দিতে থাকে। এ অবস্থায় বিভিন্ন সম্প্রদায় পাড়াগ্রামে আবদ্ধ হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে স্ব স্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্য সংরক্ষণে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। নিজেদের মধ্যে সমাজিক দূরত্বও বাড়তে থাকে, যা ছিল পীড়াদায়ক। সচেতন ছাত্র-যুবসমাজ তা মেনে নিতে পারছিল না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ সামাজিক উৎসব চাকমাদের কাছে তা ‘বিঝু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, নামে ভিন্ন হলে আচার-অনুষ্ঠান ও মূল চেতনা এক। উৎসবে নিজেদের করণীয় নিয়ে সচেতন ছাত্র-যুবকদের এক আড্ডায় প্রস্তাব ওঠে, সম্মিলিতভাবে অনুষ্ঠান করার। আগাম পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি বলতে সে রকম কিছু ছিল না। সবাই একমত হয় যে, সার্বজনীন উৎসব ‍উৎযাপন কমিটির মাধ্যমে সব সম্প্রদায়কে একসূত্রে গ্রথিত করা যাবে।

চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা তিন জাতিসত্তার উৎসবের আদ্যক্ষর নিয়ে এটি গঠিত হয়েছে। ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিঝু’ থেকে ‘বৈ-সা-বি’। জনসংখ্যার অনুপাত অনুসারে বর্ণক্রম সাজানো হয় নি, এখানে ব্যবহারিক সুবিধা আর শ্রুতিমধুরতার দিক বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ মোটেও সহজ ব্যাপার ছিল না। ছাত্র-যুবসমাজের প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার তীক্ষ্ন দৃষ্টি ছিল। এ ধরণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস গোয়েন্দা সংস্থা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো, তাতে রাজনীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহীতার গন্ধ পাবার আশঙ্কা ছিল। আর তার পরিণামও সহজে অনুমেয়। এ সমস্ত দিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে ‍উদ্যোক্তাদের সতর্কতার সাথে এগুতে হয়েছে। ‘বৈ-সা-বি’ তিন জাতিসত্তার নামে হলেও চেতনায় ছিল সব জাতিসত্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠা।

সৌভাগ্যক্রমে প্রত্যেকের উৎসবের নামের আদ্যক্ষরে “স” ও “ব” এ দু’টি বর্ণে রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যারা “বিষু”, মুরুংরা “চাংক্রান”, খুমিরা “সাংক্রাই”, চাকদের “সাংগ্রাইং”, গুর্খা-অহোমিরা “বিহু” বলে থাকে। সান্তালরা ‘বাহা পরব’ বলে থাকে (যদিও সময়ের হেরফের আছে)। কাজেই ‘বৈ-সা-বি’ বলতে গেলে সব জাতিসত্তারই প্রতিনিধিত্ব করে।

বৈসাবি উদযাপন কমিটি, পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ’র বৈ-সা-বি র‌্যালি ‘৯৬, রাঙামাটি। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত।

(৩)

প্রথম বৈসাবি অনুষ্ঠান শুরু হলো যেভাবে

খাগড়াছড়ি তখন সবে সাব-ডিভিশন সদর থেকে জেলায় ((৭ নভেম্বর ১৯৮৩) উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে বড় কোন অনুষ্ঠান করার অবস্থা ছিল না। তখন ভাড়ায় মাইক যোগাড় করাও সহজ ছিল না।

উৎসব উৎযাপন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে প্রথম বৈঠকটি হয় উত্তর খবংপুজ্জ্যা প্রাইমারি স্কুলে (স্বনির্ভর বাজার সংলগ্ন)। গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরে মা’জনপাড়া প্রাইমারি স্কুলে এবং চূড়ান্ত প্রস্তুতি পর্বে কলেজের রুমে মিটিঙ হয়। মিটিঙের সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি টাইপ করা হয় কলেজের টাইপ রাইটার দিয়ে, আমন্ত্রণপত্র সাইক্লোস্টাইল করা হয় []। অর্থ উত্তোলন, অতিথি আমন্ত্রণ, মাইক বন্দোবস্তকরণ, পুরস্কার সামগ্রী ক্রয়, মাঠ-মঞ্চ সাজ-সজ্জা কাজে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব বণ্টন হয়।

 অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিতরণী পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন তৎকালীন খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এম.এম. রেজা-ই রাব্বি, বিশেষ অতিথি ছিলেন অশোক কুমার দেওয়ান (অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট) ও সভাপতিত্ব করেন অনন্ত বিহারী খীসা। অনুষ্ঠানে দর্শক সারিতে অতিথি হিসেবে আরও ছিলেন চাবাই মগ (প্রয়াত শান্তিবাহিনীর উর্ধ্বতন নেতা), কলেজের শিক্ষক ও স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সে সময়ে শিক্ষক-গুরুজনদের একই কাতারে আসনে শিক্ষার্থীরা বসতো না, সামাজিক রীতি অনুযায়ী তা অনুমোদনীয় ছিল না। অশোক কুমার দেওয়ান ও অনন্ত বিহারী খীসা ছিলেন উদ্যোক্তাদের শিক্ষক, উভয়ে প্রয়াত হয়েছেন। মূল উদ্যোক্তরা অতিথিদের পেছনে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

সরকারি অনুষ্ঠানের বাইরে বৃহৎ পরিসরে দিন ব্যাপী এ ধরণের একটি বর্ণাঢ্য ও সুসংগঠিত আয়োজন উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানের আদলে পুরো মাঠ রঙিন কাগজের ছোট পতাকায় শোভিত ছিল। তোরণ নির্মাণ, আর্ট পেপারে সাইন পোস্ট (প্রবেশ-বাহির) ছিল। বাংলার পাশাপাশি তাতে চাকমা হরফ ব্যবহার করা হয় [], মারমা ও ত্রিপুরায় তা দেয়া সম্ভব হয় নি।

সকাল থেকে অনুষ্ঠানে চাকমা-মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় ঘোষণা দেয়ার চেষ্টা চলে, সঙ্গত কারণে এতে জড়তা ও সীমাবদ্ধতা ছিল। ক্যাসেট প্লেয়ারে তিন ভাষায় গান বাজানো হয়। সে সময় তেমন বেশি সঙ্গীত সংগ্রহ করা যায় নি। সাংস্কৃতিক নৈকট্যের কারণে রেডিও রেঙ্গুন থেকে প্রচারিত লাঞ্চ টাইম মিউজিক (দুপুর ১:১৫ টা শর্টওয়েব ৩১ মিটার ব্যান্ডে) বাজানো হয়, শহরের মনোযোগী শ্রোতারা তা বেশ উপভোগ করেন।

 খাগড়াছড়ি সদরের শিশু-কিশোররা প্রথম বারের মতো ঘিলা (Giant sea bean) খেলা ও অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া দেখার সুযোগ পায়। বাঁশ খরম দৌঁড়, বিকেলে শেষ আইটেমে শিশুদের বলি খেলা আমন্ত্রিত অতিথিদের নিকট বেশ উপভোগ্য হয়েছিল। এ ধরনের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের কোন ছবি নেই। অনুষ্ঠানের সংবাদ পত্রিকায়ও দেয়া হয় নি।

সদ্য জেলা শহর খাগড়াছড়িতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তেমন হতো না। বিনোদনের পরিসর ছিল সীমিত। জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের শুরুতে এ ধরনের অনুষ্ঠান সে সময়ে অনেক বড় পাওয়া ও সম্মানের ব্যাপার ছিল। প্রধান অতিথির ভাষণে জনাব রাব্বি আপ্লুত হয়ে উচ্চশিত প্রশংসা করেন, উদ্যাক্তাদের ধন্যবাদ জানান।  বিশেষ অতিথি ও সভাপতি তাদের ভাষণে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেন। উদ্যোক্তারা ছিল তাদের ছাত্র। ভুলবশতঃ ঘোষক স্বাগত বক্তব্য দানের কথা উল্লেখ করে নি, তা বাদ পড়ে। বিশেষ অতিথির পরে আর বক্তব্য রাখার অবকাশ ছিল না। অতিথি ও সমবেত সুধীমণ্ডলী অনুষ্ঠানের উদ্যাক্তাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য শুনতে চেয়েছিলেন। এ ধরনের ত্রুটি সত্ত্বেও সামগ্রিক বিচারে অনুষ্ঠান আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

অনুষ্ঠান শেষে শান্তিবাহিনীর সাবেক নেতা চাবাই মগ উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানান, ভবিষ্যতে আরও ভাল অনুষ্ঠানের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শুভ্রা চাকমা (প্রয়াত সাংসদ উপেন্দ্রলাল চাকমার বড় মেয়ে) ‍ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন এবং অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখে তিনি নিজের মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেন। আগত অতিথি দর্শক সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেন।

প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে উৎসব উপলক্ষে বিচ্ছিন্নভাবে ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা হয়ে থাকলেও খাগড়াছড়ি সদরে সেভাবে হতো না। প্রাপ্ত তথ্য মতে রাঙ্গামাটি শহরেও আগে এ ধরনের অনুষ্ঠান হয় নি। এখন বর্ধিত কলেবরে বিভিন্ন জায়গায় উৎসব উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়ার পাশাপাশি নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে, তার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে।

এখন অবাক মনে হলেও সে সময় বৈসাবি অনুষ্ঠানের জন্য মাইক সংগ্রহও ছিল এক দুরহ ব্যাপার। অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসককে প্রধান অতিথি হিসেবে রাখার সুবাদে জনসংযোগ দপ্তরের মাইক পাওয়া যাবে এমনটি ধারণা করেছিল উদ্যোক্তারা, এ ব্যাপারে তাদের কারোর কোন অভিজ্ঞতাও ছিল না। অফিসে আমন্ত্রণ জানাতে গেলে মিতভাষী ডিসি জনাব রাব্বি অকপটে উদ্যোক্তাদের জানান, সরকারি অনুষ্ঠান ব্যতীত জেলা জনসংযোগ দপ্তরের মাইক বাইরে ব্যবহারের নিয়ম নেই। নিয়ম অনুযায়ী দেয়া যায় না। [] উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠানের জন্য অর্থ চাইতে পারে হয়ত এমন ধারণা ছিল তার, যা তিনি তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পারতেন। কিন্তু উদ্যোক্তারা মাইক দুষ্প্রাপ্যতার কথা বললে ডিসি অনেকটা অসহায় অবস্থায় পড়েন। তিনি উদ্যোক্তাদের এনডিসি’র কাছে পাঠান। এনডিসি ছিলেন তরুণ কর্মকর্তা এবং বেশ করিৎকর্মা, উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে এবং কর্মসূচি জেনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। উদ্যোক্তাদের উপস্থিতিতে জেলা জনসংযোগ দপ্তরের কর্মকর্তা পাই হ্লা প্রু চৌধুরী (পরে মং চিফ, প্রয়াত)’কে ফোন করেন এবং মাইক যাতে যথাসময়ে কলেজ মাঠে পৌঁছায় সে ব্যবস্থা করতে বলেন। উদ্যোক্তারা মাইক নিশ্চিত করে ফিরে আসেন।

তারুণ্যের উদ্যম ও সৃষ্টির প্রেরণা থেকে উদ্যোক্তারা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ভবিষ্যতে বৈসাবি’র উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা হতে পারে, সে ধরনের চিন্তা উদ্যোক্তাদের ভাবনার মধ্যে ছিল না। সাম্প্রতিক কালের নানা কথাবার্তায় কেউ কেউ খণ্ডিত অংশ নিয়ে স্মৃতিচারণ করে থাকলেও এ নিয়ে মূল উদ্যোক্তাদের কেউ বিশদ বিবরণ কোথাও তুলে ধরেন নি।

(৪)

শুরু আগে, পূর্বপুরুষদের স্মরণ :

১৯৮৪ সালের ফুল বিঝুর দিন ভোর বেলা ছিল ঘন কুয়াশায় ঢাকা। ভোরে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল দিলীপ পণ্ডিত ছেলে টুটুলকে কাঁধে করে অনুষ্ঠানস্থলে উদ্যোক্তাদের প্রস্তুতি দেখতে আসেন। তাকে আগেই আমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়েছিল এবং অনুষ্ঠান সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। থাকতেন মা’জনপাড়ায় এক ভাড়া বাসায়। তিনি খৃস্টান আর তাকে ইউরোপিয়ানদের মত দেখাতো, ভোরে উঠে হাঁটতেন। ভোর বেলায় অনুষ্ঠানস্থলে তাকে পেয়ে উদ্যোক্তারা বেশ খুশী হয় এবং উৎসাহবোধ করে। তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়। ভোরে তখন তোরণ নির্মাণ, মাঠ ছোট পতাকায় শোভিত করার কাজ চলছিল। তিনিও আগ্রহ কৌতুহল নিয়ে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখেন এবং কার্যক্রম জেনে নেন। উদ্যোক্তারা তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রস্তুতির কার্যক্রম দেখায়। মাঠের এককোণে পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত সৌধটিও তিনি আগ্রহ ভরে দেখেন। বাঁশের বেড়া দিয়ে সেটি নির্মিত হয়েছিল কলেজের বাস্কেটবল কোর্টের সন্নিকটে একটি ঢিবিতে। খুব ভোরে সূর্যালোক ফোটার আগে উদ্যোক্তাদের ক’জন এখানে পূর্বপুরুষদের সম্মানে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। প্রথা অনুযায়ী অনুষ্ঠান শুরুর আগে অতীতে দেবতাদের স্মরণ করে পুষ্পার্ঘ্য দেয়ার বিধান ছিল, নিকটস্থ ঝর্ণা-নদীতে ফুল ভাসানো হতো। সময়ের সাথে রীতি পরিবর্তিত হয়েছে। দেবতাদের স্থলে জাতির বীরসম ‘পূর্বপুরুষদের’ স্মরণে পুস্পার্ঘ্য দেয়া হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা দেয়া হয়।

দিলীপ পণ্ডিত জ্ঞানী ব্যক্তি কথা বলতেন কুমিল্লা আঞ্চলিক টানে, তার কথায় ছাত্ররা মজা পেতো। পূর্বপুরুষদের ‍উদ্দেশ্যে পুষ্পার্ঘ্য দেয়ার উদ্দেশ্য-বিবরণ শুনে কুমিল্লার টানে বলেন, ‘আ-মি বুঝ-ছি! দেইখো, এইড্যা এইভাবে অন্যদের বুঝাইও না!’ ছাত্র-যুবকদের এভাবে পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে মিল খুঁজে পেয়ে থাকবেন হয়ত, গোয়েন্দা সংস্থার নজরে পড়লে তা নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো সন্দেহ নেই। সে আশঙ্কা থেকেই তিনি উদ্যোক্তাদের সর্তক করে দিয়ে থাকবেন নিশ্চয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতির কারণে গোয়েন্দা সংস্থার চরদের কোন উপস্থিতি বা তৎপরতা ছিল না। ভাইস প্রিন্সিপাল দিলীপ পণ্ডিত ভোরের দিকে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করলেও বিকেলের অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। পাহাড়ের সঙ্গীন পরিস্থিতিতে তিনি অনেক কিছু হিসেব করে চলতেন।

(৫)

 ‘বৈসাবি’র পরিবর্তে “বিঝু” চালু করতে আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরে সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটসমূহকে পত্র (২০০৮ সালের ৯ মার্চ) দেয়া হয়েছিল। সে সময় সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তার প্রতিবাদ জানায়, কেউ তা গ্রহণ করে নি। গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন কেউ তা মানবে না, মানতে পারার কথা নয়। ‘বৈসাবি’তে অন্য জাতিসত্তাসমূহের প্রতিনিধিত্ব নেই, পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন জাতিসত্তার শব্দে কথাটি নেই’ ধুয়ো তুলে জলঘোলা করার কোন মানে হয় না। আখেরে তাতে শাসকগোষ্ঠীর লাভ হবে।

জনগণ যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে, তারজন্য শাসকগোষ্ঠী অপপ্রচার, বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে ভীষণ তৎপর এবং এ ব্যাপারে তারা সিদ্ধহস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহৎ সামাজিক উৎসব উপলক্ষকে সরকার নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে চাইবে এতে অবাক হবারও কিছু নেই। বাস্তব অবস্থা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দিয়ে কৃত্রিম বিনোদন আয়োজন ও প্রচারণা হচ্ছে তার অংশ বিশেষ। সরকারের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত হয়েছে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, কতিপয় সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান-সংস্থা ও চিহ্নিত দালালচক্র। পাহাড়িরা সেজেগুজে, খেয়েদেয়ে নেচে বেড়ায়, জলকেলি করে, সরকারের গুণকীর্তনে মশগুল—তা তুলে ধরতে এরা মরিয়া। অনেকে প্রকৃত অবস্থা উপলদ্ধি করতে না পারার কারণে স্বার্থান্বেষী চক্রের সাথে এতে যুক্ত হয়ে পড়ে। উৎসবে স্বজাতি, সমাজের সাথে একাত্ম না হয়ে একশ্রেণীর শিকড়হীন লোক সুযোগ-সুবিধার লোভে বিত্তশালী ক্ষমতাসীনদের পেছনে দৌঁড়ায়। নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে না ধরে শাসকগোষ্ঠীর মনোরঞ্জনের জন্য তারা যা কিছু আয়োজন করে, তা সমাজে দূরত্ব তৈরি করে। উৎসবের মাহাত্ম্যও খর্ব হয়।

মূল কথা হচ্ছে, যে পটভূমিতে ‘বৈসাবি’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি তার চাইতেও খারাপ আরও বেশি উদ্বেগজনক। পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব হুমকীর সম্মুখীন।‘বাঙালি জাতীয়তা’ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। দমন-পীড়ন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে! যে চেতনাবোধ থেকে ‘বৈ-সা-বি’ প্রবর্তনের মাধ্যমে ছাত্র-যুবসমাজ ঐক্যের প্রয়াস চালিয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক ও জরুরি হয়ে পড়েছে। শাসকগোষ্ঠীর ‘ভাগ করে শাসন করার’ ঘৃণ্য কূটকৌশলের বিপরীতে ‘রাখি বন্ধন’-এর মতো বৈসাবি হচ্ছে সবাইকে ঐক্য সূত্রে গ্রথিত করার আন্দোলন। বলার অপেক্ষা রাখে না, তা জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে। মহল বিশেষের পক্ষ থেকে নানা কথা বলা সত্ত্বেও ‘বৈ-সা-বি’ নামে এখনও বিভিন্ন প্রান্তে ঐক্যবদ্ধভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিতে দেখা যায়।

নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করাই হচ্ছে আজকের দিনের বাস্তবতা। এটাই বর্তমান ছাত্র-যুবসমাজের নিকট আশু জরুরি কর্তব্য হয়ে সামনে এসেছে। ঋতুচক্রের পালা বদলে প্রকৃতিতে যেমন বৃক্ষরাজি নব পত্রপল্লব সুশোভিত হয়ে উঠছে, ছাত্র-যুবসমাজও বৈসাবির চেতনায় নব উদ্যমে জেগে উঠবে। ঐতিহ্য সংস্কৃতি বিকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। স্ব স্ব জাতিসত্তার স্বীকৃতি আদায় ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করবে। ‘বৈ-সা-বি’ নামেই হোক বা অন্য কোন নামে হোক বেঁচে থাকার জন্য অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম ভিন্ন অন্য কোন পথ নেই।

(১২ এপ্রিল ২০২২)

টিকা :

১। প্রখ্যাত সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (প্রয়াত), আনু মহাম্মদ (শিক্ষক ও জাতীয় তেল-গ্যাস সম্পদ রক্ষা কমিটির সচিব), ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা, সাংবাদিক, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের একটি দল সার্বজনীন বৈসাবি কমিটির আমন্ত্রণে ১১ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে পৌঁছেন।

২। প্রসিত বিকাশ খীসা, প্রধীর তালুকদার, দিলীপ চাকমা, পূর্ণমোহন চাকমা (নারাঙহিয়া); সুচিত্ত চাকমা, চন্দ্রোদয় চাকমা, সুভাষ বসু (মা’জনপাড়া) প্রত্যেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী; কিরীতি চাকমা (মা’জনপাড়া, ডিগ্রি ছাত্র), ১ম বর্ষের ছাত্র কল্যাণময় চাকমা, পূর্ণেন্দু বিকাশ দেওয়ান (গড়গুজ্জ্যা ছড়ি), হেমন্ত চাকমা (নারাঙহিয়া), উদয় জীবন চাকমা (খবংপুজ্জ্যা)। নারাঙহিয়া, মা’জনপাড়া, খবংপুজ্জ্যা ও গুড়গুজ্জ্যাছড়ি, গোলাবাড়ি, কমলছড়ির ছাত্র-যুবকরা অনুষ্ঠান আয়োজনে ভূমিকা রাখেন।

৩। রাঙ্গামাটি কলেজের সংকলন সংগ্রহে নেই। উদ্যোক্তাদের নাম দিতে না পারায় দুঃখিত। এটি সংযোজিত হলে এ অধ্যায় পূর্ণতা পাবে।

৪। পূর্ণমোহন চাকমা (উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী) টাইপ জানতেন। তাকে দিয়ে টাইপ করানো হয়। মিটিঙের সিদ্ধান্তবলী ও আমন্ত্রণপত্র কারোরই সংগ্রহে আছে বলে জানা নেই।

৫। দিলীপ কুমার চাকমা (উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী) ছাপানো অক্ষরের মতো লিখতে পারতেন। ব্যানার, সাইন পোস্ট লেখার দায়িত্ব ছিল তার। তখন ফ্রেন্ড সার্কেলে চাকমা হরফে লেখার চর্চা ছিল। চাকমা হরফে লিখতে কোন সমস্যা হয় নি।

৬। প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ৩ জনের একটি দল ডিসি’কে আমন্ত্রণ জানাতে যায়। দলে দিলীপ চাকমাও ছিলেন।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More