যুগান্তর রিপোর্ট

রাঙ্গামাটিতে উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি : ভুয়া বিলে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ

0

অনলাইন ডেস্ক ।। রাঙ্গামাটিতে কাগজে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ না করেই ভুয়া বিলে তিন কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা। অভিযোগ রয়েছে, এসব দুর্নীতিতে জড়িত সরকারদলীয় লোকজনসহ বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা। সম্প্রতি জেলার বরকল উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ বাস্তবায়িত এমন বিশ কাগজে প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শনসহ বিস্তারিত তথ্যানুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পিছিয়ে পড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে প্রত্যেক অর্থবছর বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তার অংশে সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় বহু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু এসব কাজ কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন দেখানো হলেও বাস্তবে অস্তিত্বই নেই সিংহভাগ প্রকল্পের।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাজ না করেই ভুয়া বিলে বিপুল সরকারি অর্থ যাচ্ছে দুর্নীতিবাজদের পকেটে। এতে জড়িত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রকৌশল শাখার কতিপয় লোকজন এবং জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ও বরকল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সবির কুমার চাকমার নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট। খোদ সরকারদলীয় লোকেরাই সিন্ডিকেটটির নাম-পরিচয় তুলে ধরেছেন।

বরকলে দুর্নীতির তথ্যচিত্র তুলে ধরে তদন্তের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের কাছে অভিযোগ করেছেন উপজেলার ভুষণছড়া ইউনিয়নের ছোটহরিণা আমতলা গ্রামের বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলাম এবং উপজেলার অজ্জেংছড়ি গ্রামের বাসিন্দা দয়াল কুমার চাকমা।

অভিযোগে বলা হয়, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য সবির কুমার চাকমার যোগসাজশে ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যকার সময়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো হলেও সেগুলোর সিংহভাগ প্রকল্প ভুয়া।

২০১৮-১৯ অর্থবছর ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন দেখানো হয় বরকল উপজেলার ভুষণছড়া ইউনিয়নের আমতলা মাদ্রাসায় অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ প্রকল্পের। কিন্তু এ প্রকল্পের কাজের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রকল্পের বিষয়ে জানাও নেই স্থানীয়দের। কাজ না হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন স্থানীয় সাধারণ লোকজনসহ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরাও। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, দু-একটি প্রকল্পের সামান্য কাজ করা হয়েছে। অন্য প্রকল্পের কোনো কাজই হয়নি।

৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ভুষণছড়া ইউনিয়নের গরইছড়ামুখ থেকে বগাছড়ি দজরপাড়া কাঁচা রাস্তা নির্মাণ কাজের চিহ্নও নেই। প্রকল্পের নামে রাস্তা উল্লেখ করা হলেও মাঝখানে কাপ্তাই লেকের পানি। ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ভুষণছড়া বাজার থেকে ভান্ডারিপাড়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ কাজ দেখানো হলেও সিকিভাগ কাজও করা হয়নি। রাস্তার যেটুকু কাজ তাও নিজেদের টাকায় করেছেন বলে জানালেন স্থানীয় মোটরবাইক সমিতির লোকেরা। বরকল উপজেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সরঞ্জাম সরবরাহের নামে ৮ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে অদৃশ্য। ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ভুষণছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের ধারক দেয়াল নির্মাণ কাজের সর্বোচ্চ ৩-৪ লাখ টাকায় কাপ্তাই লেকের পানির মধ্যে একটি দেয়াল করা হয়েছে। সেটি কোনো কাজে আসেনি। ২০ লাখ টাকায় ভুষণছড়া থেকে এরাবুনিয়া যাতায়াতের মেইন রাস্তায় ব্রিজ নির্মাণ কাজে ব্যাচ ঢালাইয়ে শুধু দুটি গর্ত করা হয়েছে। ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৮-২০ অর্থবছর মেয়াদে ৪ নম্বর ভুষণছড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত কামিনী চাকমার জমির ওপর মৎস্য বাঁধ ও পাকা সেচ ড্রেন নির্মাণ কাজে সিকিভাগ কাজও হয়নি। ভুষণছড়া মেইন রোড থেকে সরকারপাড়া পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ কাজে ৭ লাখ টাকার বরাদ্দে মাত্র ৩২ হাজার টাকার মাটির কাজ করা হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

এছাড়া ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় উপজেলার আইমাছড়া ইউনিয়নে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ত্রিপুরাছড়া মোনপাড়া গ্রামে কৃষি ও মৎস্য বাঁধ নির্মাণ এবং ২টি ১৬ হর্স পাওয়ার পাম্প মেশিন সরবরাহ কাজ দৃশ্যমান নেই। ৫ লাখ টাকায় সুবলং বরুণাছড়ি যমচুগ রাস্তা সংস্কার কাজের ২০ ভাগ করা হয়নি। ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে সুবলং ইউনিয়নে চন্দ্র চাকমার জমিতে মৎস্য বাঁধ সংস্কারকরণ কাজে বাঁধের অস্তিত্ব নেই। কাপ্তাই লেকের পানির মধ্যে একটি পাহাড়ি ঘোনায় নেট দিয়ে ঘেরা দেখা গেছে। ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বরকল উপজেলায় আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বেকার নারীদের সেলাই মেশিন সরবরাহ, ১০ লাখ ব্যয়ে উপজেলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সামগ্রী সরবরাহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহায়তা প্রকল্প (কোড নম্বর-৫০১০) ২০১৬-২০১৮ অর্থবছর ১০ লাখ টাকায় বরকল উপজেলার পূর্ব এরাবুনিয়া মৎস্য বাঁধ থেকে হারুণটিলা এলাকার আহাদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার (১-২ কিমি.) করা হয়। প্রকল্প এলাকা দেখিয়ে দিয়ে বাড়ির মালিক আহাদ বললেন, তিনি প্রকল্পের নামও শোনেননি। মোতালেব মুন্সী বলেন, একটি কোদালের কোপও পড়েনি ওই প্রকল্পের নামে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর মেয়াদকালে ১৫ লাখ টাকা বড়হরিণা ইউনিয়নে কুকিছড়া বাজার থেকে শ্রীনগর বাজার পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার কাজেও গড়মিল পাওয়া যায়। ১৫ লাখ টাকায় আইমাছড়া ইউনিয়নে জগন্নাথছড়া থেকে ঠেগা খুব্বাং পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার কাজটি করা হয়েছে ওভারলেপিং করে। এটি জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার বাস্তবায়ন করা তিন কিলোমিটার রাস্তায় ইট বিছানো কাজ।

৯ লাখ টাকায় সুবলং ইউনিয়নে কমিউনিটি সেন্টার ঘর ও পাকা সিঁড়ি নির্মাণ কাজ দেখানো হয়েছে স্থানীয় একুশে ক্লাবের নির্মাণাধীন কিঞ্চিৎ কাজ। আবার তাও হয়েছে ক্লাবটির সদস্যদের নিজেদের টাকায়।

৭ লাখ টাকায় সুবলং ইউনিয়নে সুবলং বাজারে পানীয় জলের ব্যবস্থাকরণসহ গভীর নলকূপ স্থাপন কাজের অস্তিত্বই নেই। ১০ লাখ টাকায় সুবলং বাজার ক্যাম্প থেকে মাজারঘাট পর্যন্ত ইট বিছানোর কাজ হয়েছে বড়জোর ৮০-১০০ ফুট। এ ছাড়া ৪ লাখ টাকায় বরকল ইউনিয়নে সুনীল চাকমার জমিতে পাকা সেচ ড্রেন নির্মাণ, ৮ লাখ টাকায় সুবলং ইউনিয়নে নিল রতন চাকমার বাড়ির পাশে ধান্য জমিতে মৎস্য বাঁধ নির্মাণ কাজ খুঁজে পাননি স্থানীয়রা।

এদিকে ওইসব কাগজে উন্নয়ন প্রকল্পে শতভাগ বাস্তবায়ন দেখিয়ে সব টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক তথ্যসূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এসব প্রকল্পে তদারকির দায়িত্বে থাকা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের উপ-সহকারী রিগ্যান চাকমা বলেন, সবগুলো প্রকল্প শতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। নিজেই সব প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে তদারকি করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য সবির কুমার চাকমা বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন তদারকির দায়িত্ব জেলা পরিষদের প্রকৌশল শাখার। কাজেই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা- তা জানবে তারা। আর প্রকল্পের সুবিধাভোগী কর্তৃপক্ষ যদি শতভাগ কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে মর্মে প্রত্যয়নপত্র দেয় তাতে আমার কি করার আছে?

ফোনে যোগাযোগ করা হলে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী বিরল বড়ুয়া বলেন, প্রকল্পের ফাইলপত্র না দেখে বিস্তারিত বলা যাবে না। এ ধরনের একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্তে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

সূত্র: যুগান্তর


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত/প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More